রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

দৃষ্টিনন্দন নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

দৃষ্টিনন্দন নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী

দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি প্রাচীন স্থাপত্যকলার দৃষ্টিনন্দন এক নিদর্শন। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সৌন্দর্যমন্ডিত এ রাজবাড়ীটি শহরতলির দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে আজও কালের সাক্ষী হয়ে উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। এই রাজবাড়ীতে একসময় শোনা যেত নূপুরের ঝঙ্কার আর সেই সঙ্গে মধুরকণ্ঠের সুর মূর্ছনা। ছিল পাইক-পেয়াদার কর্মচাঞ্চল্য, রাজ-বাজন্যবর্গের গুরুগম্ভীর অবস্থান। ছিল বিত্তবৈভবের ঝলক। এখন আর সেসব নেই। শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে সেই দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীটি উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে আজও স্মৃতি বহন করে চলেছে।

প্রতিষ্ঠা : দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। দয়ারাম রায় ১৭০৬ সালে রাজা রামজীবনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে যে জমি পেয়েছিলেন ১৭৩৪ সালে তার ওপরেই স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন এই দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন। নাটোর শহর থেকে প্রায় দুই মাইল উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে এই রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে অতিথি হিসেবে যোগ দেন। অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন প্রায় ১৮ মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিক¤ন্ডেপ রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। রাজা প্রমদানাথ ১৮৯৭-১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির ওপর এই রাজবাড়ীটি পুনর্নির্মাণ করেন। ফটকের সামনে রয়েছে আরও ২.৮৯ একর জমি। রাজবংশের রাজারা : দিঘাপতিয়া রাজবংশের রাজারা ছিলেন আধুনিক মনমানসিকতার অধিকারী। ১৭১০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই রাজবংশের রাজারা কৃতিত্বের সঙ্গেই রাজ্য শাসন করেন। তারা হলেন- রাজা দয়ারাম রায়, জগন্নাথ রায়, প্রাণনাথ রায়, প্রসন্ননাথ রায়, প্রমথনাথ রায়, প্রমদানাথ রায়, প্রতিভানাথ রায় এবং অষ্টম ও বংশের শেষ রাজা কুমার প্রভাতনাথ রায়। ১৯৬২ সালে তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। যা আছে এই রাজবাড়ীতে : রাজবাড়ীতে মোট ১২টি ভবন আছে। এগুলো হলো-  প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারি ভবন, ৩টি কর্তারানী বাড়ি, প্রধান ফটক রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি ভবন। মূল ভবনসহ অন্যান্য ভবনের দরজা-জানালা মূল্যবান কাঠে নির্মিত। বাগানটি ইতালি গার্ডেন নামে পরিচিত। বাগানে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের দুর্লভ সব ফুলের গাছ। আছে শ্বেতপাথরের ৪টি নারী ভাস্কর্য। রাজপ্রাসাদ : দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর মূল প্রাসাদটি একতলা। এতে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলঘর। বেশ উঁচু হলঘরের শীর্ষে রয়েছে একটি গম্বুজ। হলঘরের মাঝে বেশকিছু আসবাবপত্র রয়েছে। উত্তরা গণভবনে উচ্চ পর্যায়ের কোনো সভা হলে এ হলঘরেই হয়। উপরে রয়েছে ঝাড়বাতি। এই ভবনের এক পাশে একটি ঘরে রয়েছে রাজসিংহাসন। তার পাশের ঘরটি রাজার শয়নঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাটটি শোভা পাচ্ছে। কুমার ভবনের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। দক্ষিণে ছিল রানীমহল। আজ আর সেটা নেই। ১৯৬৭ সালে ভেঙে ফেলা হয়েছে। রানীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা আজও স্মৃতি বহন করে চলেছে। পাশে ছিল দাসী ভবন। রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল। সেখানে হরিণ আর খরগোশসহ অনেক জীবজন্তু ছিল। এর দুই পাশে রয়েছে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের তৈরি দুটি কামান। মূল প্যালেসের মাঠের পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। মূল রাজপ্রাসাদের প্রবেশপথে সিঁড়ির দুই পাশে দুটি কালো কৃষ্ণমূর্তি। এরপরই রয়েছে ধাতব বর্ম। এটা পরেই রাজা যুদ্ধে যেতেন। সর্বশেষ অবস্থা : ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়ার রাজা ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজপ্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন এবং মন্ত্রিসভার কয়েকটি বৈঠক করেন। এরপর জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, এরশাদ ও শেখ হাসিনা এই উত্তরা গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর সেই রাজা-রানীদের এখন আর কেউ নেই। আগের সেই গৌরবও নেই। গণভবন হলেও রাজবাড়ীটি এখন শুধুই মুকুটহীনভাবে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা হিসেবে পড়ে রয়েছে।

সর্বশেষ খবর