রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

জাগছে ক্ষতচিহ্ন, দিশাহারা মানুষ

এখনো বিপৎসীমার ওপরে ১২ নদীর পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাগছে ক্ষতচিহ্ন, দিশাহারা মানুষ

নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে ঢাকার নিম্নাঞ্চল। ছবিটি গতকাল মিরপুরের চটবাড়ী এলাকা থেকে তোলা -রোহেত রাজীব

টানা মাসব্যাপী বন্যার পর কমতে শুরু করেছে অধিকাংশ নদ-নদীর পানি। এতে অনেক এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বানভাসিরা। কিন্তু, এক মাসের বন্যায় সব যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বন্যার পানি নামতেই জেগে উঠছে ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা আর নদীভাঙনে কেউ হারিয়েছেন শেষ সম্বল ভিটেমাটি ও থাকার ঘরটি, কেউ হারিয়েছেন জমির ফসল, কেউ হারিয়েছেন চাষের মাছ বা খামারের মুরগি। দিনের পর দিন কাজ না থাকায় শেষ করে ফেলেছেন জমানো টাকা-পয়সা। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব মেলাতে গিয়ে চোখে  যেন শর্ষে ফুল দেখছেন দুর্গত এলাকার মানুষগুলো। কীভাবে হবে ঘরবাড়ি মেরামত, কীভাবে চলবে আগামী দিনগুলো- সেই চিন্তা ২১ জেলার ৩০ লক্ষাধিক মানুষের। এদিকে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে অনেক এলাকায় আবার তীব্র হয়েছে নদীভাঙন। এদিকে অধিকাংশ নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল সকালেও পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ১৯টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। তবে হ্রাস পেয়েছে ৭৯টির পানি। অপরিবর্তিত ছিল তিনটি নদীর পানি। ১২টি নদীর পানি ১৬টি স্টেশনে এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে অনেক এলাকা এখনো বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ঢাকার আশপাশের তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি গতকাল কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে তুরাগ নদের পানি মিরপুর পয়েন্টে গতকালও বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বালু নদীর পানি ছিল বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপরে। এ কারণে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের প্লাবিত অনেক এলাকা এখনো বন্যার পানির নিচে রয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে ঢাকার নিম্নাঞ্চল, সাভার, আশুলিয়ার অনেক পরিবার। তবে গত পরশুর চেয়ে গতকাল বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয় রাজধানীতে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদ-নদী ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে এবং তা আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আজকের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ছাড়াও সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও তথ্য- সুনামগঞ্জ : ফসল রক্ষা করতে সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সুরমার সাত শাখা নদীর উৎসমুখে স্থায়ী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় এ অঞ্চলে বেড়ে গেছে বন্যার প্রকোপ। পানি নিষ্কাশনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ায় বানের পানি ফুলেফেঁপে প্রতি বছরই বসতবাড়ি, কাঁচা-পাকা সড়কের ক্ষতি করছে। দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এ অঞ্চলের জনসাধারণকে। নদী-খাল বন্ধ করে দেওয়ায় ঘন ঘন বন্যার পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সম্প্রতি তিন দফা বন্যায় সুনামগঞ্জ-ছাতক সড়কের দোয়ারাবাজার উপজেলা অংশের নোয়াগাঁও, কাঞ্চনপুর ও রাজনপুর এলাকায় বন্যার পানির তোড়ে সড়ক ভেঙে এক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু মানুষের বসতবাড়ি। সুনামগঞ্জ-হালুয়ারঘাট সড়কের ধারারগাঁও এলাকায় পানি প্রবাহের দুটি পথ সড়ক যোগাযোগের জন্য স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আগে সেতু ও কালভার্ট ছিল। এবারের বন্যায় ওই অংশেও সড়কের একটি বড় অংশ ভেঙে গেছে। সরকারি তথ্যমতে, সাম্প্রতিক বন্যায় জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পৌর এলাকা, গ্রামীণ অবকাটামো মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জেলার সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। জনগুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো সড়কের ২২টি স্থান সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গেছে। বন্যায় কেবল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের ৯০০ কিলোমিটার সড়কে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। সাভার : ভয়াভহ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা। চরম দুর্ভোগে পড়েছে গার্মেন্টস শ্রমিকসহ কয়েক লাখ মানুষ। বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। বানভাসি মানুষের দাবি, এ দুর্ভোগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ তারা পাননি। পানিবন্দী হয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। এতিকে বন্যার পানি বেড়ে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে; তলিয়ে গেছে আঞ্চলিক সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সাভার-আশুলিয়া-ধামরাইয়ের (ঢাকা বিভাগ-২) পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বরত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাহাত রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েক দিন ধরে তুরাগ, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সাভারে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

এদিকে শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানির সঙ্গে কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মিশে জনজীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আশুলিয়া, ধামসোনা, শিমুলিয়ার, পাথালিয়া, ইয়ারপুর, সাভার সদর, তেঁতুলঝড়া, বনগাঁও, আমিনবাজার, ভাকুর্তা, বিরুলিয়া ও কাউন্দিয়ার নিচু এলাকাগুলোর বেশিরভাগ ঘরে বন্যার পানি ঢুকে গেছে। কিছু এলাকায় ঘরের ভিতরে পানি না ঢুকলেও পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন বাসিন্দারা। শিমুলিয়ার ১৩৯টি গ্রাম ডুবে গেছে। কুড়িগ্রাম : ভুরুঙ্গামারীতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুধকুমর নদীর তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিনের নদীভাঙনে বিলীনের পথে উপজেলার পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকডাঙ্গা ও চরভুরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রাম। ভাঙনের শিকার হয়েছে ওই গ্রামের তিনটি মসজিদসহ কয়েকশ হেক্টর আবাদি জমি ও শতাধিক বসতবাড়ি। নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করায় হুমকিতে রয়েছে উপজেলার দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দিশাহারা হয়ে পড়েছে ভাঙনকবলিত এলাকার নদী তীরবর্তী পরিবারগুলো। অনেকেই ঘরের মালপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ আবার সেই সময়টুকুও পাচ্ছেন না। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ওমর ফারুক জানান, নদী শাসনের জন্য একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। কালজানি ও দুধকুমর নদীর ভাঙন রোধে ‘দুধকুমার নদী উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে।

সর্বশেষ খবর