রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রাতারাতি দখল করা হয় ১০ প্রতিষ্ঠান

ফরিদপুরে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের অবৈধ কর্মকাণ্ড

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

ফরিদপুর আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী, বর্তমানে গ্রেফতার রুবেল-বরকত ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একে একে দখল করে নিয়েছিলেন স্থানীয় ১০টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে হটিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন সময়ে দায়িত্ব প্রাপ্তদের। অভিযোগ করে অনেকেই বলেছেন, তারা যেভাবে রাতের আঁধারে প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করেছিল, তখন তাদের বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা কারও ছিল না। একদিকে ক্ষমতার প্রভাব অন্যদিকে, ‘হাতুড়ি বাহিনী’, ‘হেলমেট বাহিনী’-এর ভয়ে সেই সব প্রতিষ্ঠান থেকে সজ্জন ব্যক্তিরা সরে যেতে বাধ্য হন। অনেকেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন।

ফরিদপুরের বেশ কয়েকজন প্রবীণ এবং যাদের হাতে গড়ে উঠেছিল এসব প্রতিষ্ঠান, তারাও অপমান সইতে না পেরে সেখান থেকে চলে যান। এ নিয়ে কখনো কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি ক্ষমতাশালী এক ব্যক্তির ভয়ে। বর্তমানে দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযানে আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা আটক হওয়ার পর কেউ কেউ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীরা ক্ষমতার দাপট দেখাতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে তাদের মনোনীত লোকদের বসাতে থাকেন। দলীয় বলয়ে যখন তাদের ষোলোকলা পূর্ণ হয় তখন তারা হাত বাড়ান ফরিদপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। একে একে দখল করে নেন জেলা শিল্পকলা একাডেমি, ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ফরিদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, শিশু হাসপাতাল, প্রেস ক্লাব, ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপ, ফরিদপুর জেলা মিনিবাস মালিক সমিতি ও বাজার বণিক সমিতি। ফরিদপুরের সচেতন মহলের দাবি, বরকত-রুবেল গংরা প্রথমেই দখল করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি। সেই সময়ে শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে সেখানে বসানো হয়। তাদের অনুসারীরা চেয়ারে বসে এই প্রতিষ্ঠানটিকে একেবারেই ধ্বংস করে দেয়। নির্বাচন দেওয়া হয় না দীর্ঘদিন। ফলে সেখানে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়। এক সময় জাঁকজমক অবস্থায় শিল্পকলা একাডেমিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলেও এখন বছরের পর বছর কোনো অনুষ্ঠান হয় না। জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজন বলেন, প্রতি বছর ডাকযোগে একটি চিঠি পাই সদস্য ফি দেওয়ার। তাছাড়া আর কোনো চিঠি কিংবা দাওয়াত পাই না। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন না হওয়ায় সেখানে লুটপাটের রাজত্ব চলছে। ফরিদপুরের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন হচ্ছে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। এই সংগঠনটি দখলে নিতে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয় নির্বাচিত সভাপতিকে। পরবর্তীতে তাদের ছক অনুযায়ী একজনকে সভাপতি বানানো হলেও তিনি তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ জানিয়ে সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। চেম্বারের সদস্য করা হয়েছে এমন ব্যক্তিকে যারা কোনোদিন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনা এবং তাদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতেই ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে অনেককেই সদস্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে বিভিন্ন সময় চাপের মুখে ফেলে এ চক্রটি নানা ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে।

ফরিদপুর জেলাই শুধু নয়, দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘ফরিদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ’। এ প্রতিষ্ঠানটির শুরুতে যারা ছিলেন তাদের বিভিন্ন সময় অপমান-লাঞ্ছিত করে সেখান থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়। অবৈধভাবে এবং ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নতুন তিনশ সদস্য নেওয়া হয়। তারা সবাই বরকত-রুবেলদের অনুসারী। চিকিৎসা সেবায় দীর্ঘদিনের স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানানো হয়। এখানে নতুন করে চাকরি দেওয়া হয়েছে ইচ্ছে মতো। এর আগে নিয়মানুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাশালীদের তালিকার ব্যক্তিদের চাকরি না হওয়ায় সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখতে দেওয়া হয়নি। তাদের কথামতো না চলায় সরিয়ে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠাকালীন অনেককেই। ফরিদপুর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দখল করে নেওয়া হয় একই কায়দায়। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজনকে সরিয়ে অনুপ্রবেশকারীরা এটি দখলে নেয়। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সেখানে নতুন সদস্য করা হয়ে কয়েক হাজার। নিজেদের বলয়ের লোক বসিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে কয়েক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। একই অবস্থা ফরিদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থায়ও। ক্রীড়াবান্ধব ব্যক্তিদের হটিয়ে বসানো হয় তাদের পক্ষের লোকদের। বর্তমানে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খন্দকার নাজমুল হাসান লেভী দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পুলিশের হাতে আটক রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, ক্রীড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন অনেককেই সদস্য করা হয় বেআইনি ভাবে। ফরিদপুরের স্বনামধন্য আরেকটি চিকিৎসা কেন্দ্র ‘ফরিদপুর জাহেদ শিশু মেমোরিয়াল হাসপাতাল’। এই হাসপাতালটির সাবেক কয়েকজনকে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদে জায়গা করে নেন বর্তমান সময়ের আলোচিত কয়েক ব্যক্তি। বিগত দিনে যারা হাসপাতালটি নির্মাণে এবং সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিকদের অন্যতম স্থান প্রেস ক্লাব। সেই প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত কমিটিকে রাতের আঁধারে অবৈধ পন্থায় হটিয়ে তা দখল করে নেওয়া হয়। প্রেস ক্লাবের কোনো সদস্য কিংবা সাংবাদিক না হয়েও সভাপতি বনে যান বর্তমানে পুলিশের হাতে আটক ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। সেই সময়ের নির্বাচিত সভাপতি কবিরুল ইসলামের নামে মিথ্যা একটি চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে তাকে ফরিদপুর থেকে খেদানো হয়। প্রেস ক্লাব দখল করে বিভিন্ন স্থান থেকে তারা নানা সুবিধা আদায় করে বলে অভিযোগ আছে। প্রেস ক্লাবের মতো একই কায়দায় রাতের আঁধারে দখল করে নেওয়া হয় ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপ ও জেলা মিনিবাস মালিক সমিতি। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত সদস্যদের ক্ষমতার প্রভাব ও ভয়ভীতি দেখিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা দখল করে নেন। দীর্ঘদিন ধরে যারা বাস মালিক গ্রুপ ও মিনিবাস মালিক সমিতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তাদের বাদ দিয়ে বরকত-রুবেল গংরা তা দখল করে নেন। পরবর্তীতে বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি নির্বাচিত হন বর্তমানে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে আটক ও দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং মামলার অন্যতম আসামি সাজ্জাদ হোসেন বরকত। বাস মালিক না হয়েও তিনি রাতারাতি কয়েকটি বাসের মালিক দেখিয়ে সভাপতি বনে যান। একই অবস্থা ফরিদপুর জেলা মিনিবাস মালিক সমিতিটিও। সেখানেও নির্বাচিত ব্যক্তিদের সরিয়ে দিয়ে দখল করে নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের লোক বসিয়ে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফরিদপুর জেলা সদরের ব্যবসায়ীদের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাজার বণিক সমিতি। সেই সমিতিও তাদের থাবা থেকে বাদ যায়নি। শুধুমাত্র অনুপ্রবেশকারীদের কথা না শোনায় সেখান থেকে বাদ দেওয়া হয় নির্বাচিত সভাপতি সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে। তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এখান থেকে সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে শুধু বাদই নয়, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটিও ভেঙে দেওয়া হয়। সৈয়দ মাসুদকে সরিয়ে তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে পদ দখলে দিয়ে ‘বাজার বণিক সমিতি’টিও দখলে নেওয়া হয়। এ ছাড়া ফরিদপুরের বিভিন্ন সংগঠন ও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা কোনোটিই বরকত-রুবেল গংদের থাবা থেকে মুক্ত থাকেনি।

সর্বশেষ খবর