জ্বালানি হিসেবে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে বাংলাদেশ। এই ধারাবাহিকতায় সরকার দেশে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল, এর সংখ্যা কমিয়ে আনার কথা ভাবছে। বিশেষ করে কয়লার জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং আগের চেয়ে তুলনামূলক বিদ্যুতের চাহিদা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় কয়লা ব্যবহারের জন্য সরকার নতুন চিন্তাভাবনা করছে। এমনকি নতুন যে জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে, সেখানেও কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে বলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, কয়লার জন্য যে জমির প্রয়োজন তা পরিমাণে অনেক বেশি। আবার কয়লার পরিবহনও সহজ নয়। এ ছাড়া কয়লার যে পরিবশগত মূল্য, তাও অনেক বেশি। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি তো আছেই। সব মিলিয়ে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনছে। এমনকি নতুন যেসব কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের আলোচনা প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে, তা বাস্তবায়নে যাবে না বলে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার পাঁচ বছর পরপর জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যান পুনর্মূল্যায়ন করে। ২০১০ সালে যে জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে আসার কথা ছিল। আর এ ৫০ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশই ছিল দেশীয় এবং ২৫ শতাংশ আমদানি করা কয়লা। ২০১৬ সালে আবার যখন জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়, তখন কয়লার ব্যবহার কমিয়ে ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আপাতত দেশীয় কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে না। বলা যায় আমদানিকৃত কয়লার ওপর নির্ভর করেই জ্বালানি পরিকল্পনা করা হয়। সে সময় কয়লাকে সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জ্বালানি পরিকল্পনা আবার পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সম্প্রতি বিদ্যুতের চাহিদাও কমে আসছে। এ বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃত চাহিদা এ পর্যন্ত ১২ হাজার মেগাওয়াটের ওপর ওঠেনি। সে হিসেবে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের যে চাহিদা নির্ধারণ করা হবে তাও কমে আসবে। অর্থাৎ জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যানের পুনর্মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রেক্ষাপট আরও কমিয়ে আনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা যখন নতুন জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যান পুনর্মূল্যায়ন করে দেখব যে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, তখন কয়লার ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই কমিয়ে আনব। বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক যে প্রকল্পগুলোর আলোচনা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হবে। তবে নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোর কাজ চলতে থাকবে।’ তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জ্বালানি পরিকল্পনায় সাশ্রয়ী জ্বালানির কারণে কয়লাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সে সময় গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে অন্য জ্বালানিরও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কয়লা এখন আর সাশ্রয়ী জ্বালানি নয়। পরিবেশকর্মীরাও মনে করেন, কয়লার ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ মারাত্মক জলবায়ুু-ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আর বাংলাদেশ যদি বিদ্যুতের উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে দেয়, তবে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে পারবে। এর পাশাপাশি কয়লার বিকল্প হিসেবে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎশক্তির উৎসগুলোকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।
বর্তমানে দেশের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক মেগা প্রকল্পের মধ্যে আছে বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্লান্ট, কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট, মহেশখালীতে বিপিডিবি ও সিঙ্গাপুরের যৌথ মালিকানায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট, মহেশখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট, মহেশখালীতে বিপিডিবি ও টিএনবি মালয়েশিয়া যৌথ মালিকানায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট, মহেশখালীতে বিপিডিবি ও সিএইডিএইচকে, চায়নার মালিকানায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট, মহেশখালীতে বিপিডিবি ও কেপকো, কোরিয়ার যৌথ মালিকানায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট এবং পায়রা, পটুয়াখালীতে এনডব্লিওপিজিসিএল ও সিএসসি, চায়নার যৌথ মালিকানায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে দুটি ছাড়া অন্যগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিলে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে এসেছে। আর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৪৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে আরেকটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্টটির অগ্রগতি গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ছিল ২৬.১৬ শতাংশ। করোনায় এ দুই প্রকল্পের কাজই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার কারণে ধীরগতিতে হলেও মাতারবাড়ী ও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। আমরা আশা করছি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শেষে আগামীতে আমরা এ মেগা প্রকল্পের কাজে যে বাধা এসেছে তা দ্রুত পুষিয়ে নিতে পারব।’