শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ভাঙনে বিলীন বাঁধ সড়ক

ফের প্লাবিত উত্তরের চরাঞ্চল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাঙনে বিলীন বাঁধ সড়ক

এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা বন্যার পর অধিকাংশ নদ-নদীর পানি কমে গেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিপৎসীমার ওপরে থাকা নদ-নদীর সংখ্যা ১৪টি থেকে তিনটিতে নেমে এসেছে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে সবে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে বানভাসি মানুষ। এর মধ্যেই গতকাল ফের প্লাবিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার চরাঞ্চল। একই সঙ্গে তীব্র ভাঙনে বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলার মানচিত্র। শুধু ঘরবাড়ি, আবাদি জমিই নয়, নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক শহররক্ষা বাঁধ। টানা বন্যার দুর্গতির  মধ্যে ভাঙনে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক। যদিও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সকালে দেশের কোনো জেলা বন্যাক্রান্ত ছিল না। দেশের মধ্যে শুধুমাত্র গুড় নদী, ধলেশ্বরী নদী ও টঙ্গী খাল বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে গত ৬ আগস্টও বিপৎসীমার ওপরে ছিল ১৪টি নদ-নদী। তবে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল থেকে কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্ধশতাধিক চরের নিচু এলাকা আবারও প্লাবিত হয়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে সদ্য রোপণ করা রোপা আমনসহ কিছু বাড়িঘর। এ ছাড়া ধরলা নদীর তীব্র ভাঙনে সদর উপজেলার সারডোব এলাকায় বিকল্প বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধেও দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। বৈদ্যুতিক খুঁটি নদীতে ভেঙে পড়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এলাকা। যমুনার পানি ফের বৃদ্ধিতে সিরাজগঞ্জের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি কমেছে। তবে ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৩৩টিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গঙ্গা-পদ্মা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনার অধিকাংশ প্রধান নদীর পানি কমছে। তবে বাড়ছে কুশিয়ারা ও সোমেশ্বরীর পানি সমতল। অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চাঁদপুর : শহর রক্ষা বাঁধের পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। বুধবার রাতে ওই এলাকার বাঁধসহ প্রায় ২৫ মিটার এলাকায় ভাঙন শুরু হয়। এতে সড়কের বেশ কিছু অংশ ও বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ নদীগর্ভে চলে গেছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এলাকা। বৃহস্পতিবার সকালে গিয়ে দেখা গেছে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নতুন করে ২৫ মিটারের সঙ্গে বাঁধের আরও ৬০/৭০ মিটারে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে। স্থায়ী ও শক্তিশালী বাঁধ না হলে বাণিজ্যিক এলাকা পুরানবাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ হাজার হাজার ঘরবাড়ি মেঘনায় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা। স্থানীয় বিমল চৌধুরী বলেন, গত বছর থেকে ভাঙন এলাকাটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ওই সময় মন্ত্রীসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ভাঙন স্থান পরিদর্শন করেছেন। ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে এখানে স্থায়ী বাঁধ করার আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনো কোনো কাজ শুরু হয়নি। যখন ভাঙন দেখা দেয়, তখন কিছু বালু ভর্তি ব্যাগ ফেলা হয়। আবার ভাঙন কমলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। গত ২০ দিন আগেও একবার ভাঙন দেখা দিয়েছিল। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড যে স্থানটি ঝুঁকিপূর্ণ নির্ধারণ করেছিল, সেখানেই এখন ভাঙন শুরু হয়েছে। চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন জানান, ভাঙন প্রতিরোধে আমারা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে পানির গভীরতা প্রায় ৬০ ফুট। তারপরও কাজ বন্ধ নেই।

কুড়িগ্রাম : নদ-নদীর পানি বাড়ায় কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে ফের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চার সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরের পর আবার পানি কমে ধরলার পানি বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানি বেড়ে অর্ধশতাধিক চরের নিচু এলাকা আবারও প্লাবিত হয়েছে। আবার ধরলা নদীর তীব্র ভাঙনে সদর উপজেলার সদর উপজেলার সারডোব এলাকায় নতুন করে বিকল্প বাঁধের চার মিটার ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। ওই এলাকা থেকে ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন এলাকাবাসী। অনেক গৃহহীন মানুষ চলে যাচ্ছেন বাঁধ ও উঁচু রাস্তায়। গত চার দিনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে আরও শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, ওই এলাকার নুর হোসেন ও তার পরিবার নৌকায় করে ঘরবাড়ির মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘হামার সউগ শেষ হয়া গেল বাবা। আস্তাত যায়া উঠি, তাতো মাইনসে বাধা দেয়। কোথাও থাকার জায়গা হামার নাই।’ এবারের বন্যায় আগেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিকল্প বাঁধটির ৪০০ মিটার অংশ বিলীন হয়ে যায়। এতে গৃহহীন হয় দুই শতাধিক পরিবার। পাউবোর আরিফুল ইসলাম বলেন, পানি নেমে গেলে ৮০০ মিটার অংশে স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষার কাজ করা হবে। তখন আর ভাঙনের সমস্যা থাকবে না। এ ছাড়াও বন্যায় জেলায় ৩৭ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার ১৯টি পয়েন্টে ভাঙন প্রতিরোধে পাউবো কাজ করছে।

সিরাজগঞ্জ : তিন দফা বন্যার পর পানি কমে বিপৎসীমার নিচে নামলেও গতকাল থেকে যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ফের বাড়তে শুরু করেছে। এতে নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিতরা বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিলেও পানি বাড়ায় আবারও বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। এতে নতুন করে দুর্ভোগে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। এতে চরম দুশ্চিন্তায় আছে বন্যাকবলিতরা। প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হওয়ায় বিপাকে পড়েছে কৃষক। নদীভাঙন তীব্র হওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে যমুনা পাড়ের মানুষের। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুর্গতরা। এর মধ্যেই ফের যমুনার পানি বাড়তে থাকায় আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। চর মালসাপাড়ার গৃহবধূ মর্জিনা খাতুন বলেন, প্রায় এক মাস সাত দিন বাঁধে থাকার পর ভাঙাচোরা ও কাদাযুক্ত ঘর লেপে ঠিক করে কোনোমতে আশ্রয় নিয়েছি। ফের পানি বাড়তে শুরু করেছে। আবার পানি উঠলে এই ঘরের আর কিছুই থাকবে না। আয় রোজগার না থাকায় ঘর মেরামত করাও সম্ভব হচ্ছে না। এত কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর