বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

রোগবালাইয়ে জর্জরিত বন্যাদুর্গতরা

কমছে নদীর পানি, ভাঙছে পাড়, বৈরী আবহাওয়ায় বিভিন্ন রুটে লঞ্চ বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রোগবালাইয়ে জর্জরিত বন্যাদুর্গতরা

ভোলার ইলিশা লঞ্চঘাটের পন্টুন জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নদ-নদীর পানি কমে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে রোগব্যাধি। পানিবাহিত ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিসসহ নানা ধরনের চর্ম রোগে জর্জরিত বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। মিলছে না প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ওষুধ। চরম সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে বাস করছে অসংখ্য পরিবার। এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের ফলে সারা দেশেই কমবেশি বৃষ্টি হচ্ছে, যা বন্যাদুর্গত মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে সব ধরনের লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়ায় সব ধরনের নৌপারাপার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া এখনো জোয়ারের পানিতে প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে অনেক উপকূলীয় এলাকা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার-এনডিআরসিসি সূত্রে জানা গেছে, ২৫ আগস্ট পর্যন্ত বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার ৭ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৮ পরিবারের ৪৯ লাখ ৫২ হাজার ৪৩৭ জন বানভাসি। খাদ্য, পানি, আবাসন সংকটের পাশাপাশি রোগব্যাধির কারণে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে তারা। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, দীর্ঘ ৪৬ দিন পানিতে তলিয়ে থাকায় বর্জ্যমিশ্রিত কাদায় পূর্ণ ঘরের ভিতর-বাইর। অনেকের ঘরদুয়ার একেবারেই ভেঙে গেছে। তার ওপর চলছে থেমে থেমে বৃষ্টি। বন্যার কারণে ব্যবহার-অনুপযোগী হয়ে পড়েছে টিউবওয়েলগুলো। পুকুরে ঢুকেছে দূষিত পানি। এতে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বাধ্য হয়ে বানভাসিরা দূষিত পানি পান করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষিত কাদাপানির সঙ্গে দিনের পর দিন বাস করায় হাত-পায়ে দেখা দিয়েছে চর্মরোগ। কিছু কিছু এলাকায় মেডিকেল টিম কাজ করলেও সবার ভাগ্যে চিকিৎসা মিলছে না। অভাব রয়েছে প্রয়োজনীয় ওষুধেরও। করোনার কারণে স্থানীয় হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা মিলছে না বলে অভিযোগ বন্যাদুর্গতদের। এর পাশাপাশি নদী ভাঙনে দিশাহারা নদীতীরবর্তী এলাকার অনেক মানুষ। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল সকালের তথ্যানুযায়ী দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি কমছে। গতকাল শুধু ধলেশ্বরী ও পদ্মার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে ২৪ ঘণ্টায় ধলেশ্বরীর পানি ৮ সেন্টিমিটার ও পদ্মার পানি ৫ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। আজ মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাব ও সাগরে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে। সাগর ও নদ-নদী উত্তাল রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার নৌকা, ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১ থেকে ২ ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার হতে পারে। আমাদের স্থানীয় সংবাদকর্মীদের পাঠানো আরও তথ্য-

ভোলা : বৈরী আবহাওয়ায় মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে ইলিশা ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাট। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে লঞ্চঘাটের পন্টুন। বাতাসে উড়িয়ে নিয়েছে ঘাটের তিনটি ছোট দোকান। জোয়ারের পানিতে জাফর ফরাজি, আমির ফরাজি, এমরান, মোস্তফা, সোহাগ, রিয়াজের দোকানসহ ১০-১২টি দোকানের মালামালের ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে পানির চাপ না কমায় ভোলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ভাঙা বাঁধ সাত দিনেও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ফলে গতকাল আবারও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম।

নোয়াখালী : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীতে গতকাল সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজাউল করিম বলেন, ‘সমুদ্র উপকূলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত জারি করে সব ধরনের নৌপারাপার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাছধরা নৌকা, ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করতে বলা হয়েছে।’ এ ছাড়া হাতিয়ার চেয়ারম্যানঘাট থেকে নলচিড়া ঘাটে চলাচলকারী সরকারি সি-ট্রাকও গতকাল সকাল থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। রাজবাড়ী : বৈরী আবহাওয়ার কারণে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএর আরিচা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফরিদুল ইসলাম জানান, পদ্মা উত্তাল রয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের ১৭টি লঞ্চ বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় লঞ্চ চলাচল শুরু হবে। এর আগ পর্যন্ত ফেরিতে নদী পার হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

বরিশাল : বৈরী আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে গতকাল সকাল থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ নির্দেশনা বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের ট্রাফিক পরিদর্শক মো. কবির হোসেন। তবে বরিশাল-ঢাকা রুটের নৈশ লঞ্চ চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কংস নদের ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতভিটা ও ফসলি জমি। পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন তীব্র হয়েছে। মুহূর্তে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে মানুষের তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন। বাঁশ, ডালপালা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর শেষ চেষ্টা করছে নদীতীরবর্তী আতঙ্কিত পরিবারগুলো। সাম্প্রতিক কয়েক দফা আকস্মিক ভাঙনে স্বদেশী ইউনিয়নের কয়েক একর ভূমি নদীগর্ভে চলে গেছে। অন্তত ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ভাঙন ঠেকানো না গেলে অচিরেই স্বদেশী ও শাকুয়াই ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী শতাধিক বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

সর্বশেষ খবর