রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

বাহারি টাকার জাদুঘর

মোস্তফা কাজল

বাহারি টাকার জাদুঘর

দেয়ালে সাজানো থরে থরে রং-বেরঙের নকশা করা বাহারি টাকা। আছে পয়সাও। তবে এসব টাকা-পয়সার বেশির ভাগই অচল। এগুলোর রয়েছে অ্যানটিক ভেল্যু। প্রাচীন আমল থেকে এই ভূখে  প্রচলিত প্রায় সব মুদ্রা দিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘরটি। বলছি বাংলাদেশের একমাত্র টাকার জাদুঘরের কথা। এটির অবস্থান রাজধানী ঢাকার মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তলায়। এখানে স্থান পেয়েছে অনেক দুর্লভ মুদ্রা। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন সময়ের বিনিময় প্রথার চিত্রাবলি। ২০১৩ সালে মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘টাকার জাদুঘর’। জাদুঘরের মহাব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবীর জানালেন প্রতিষ্ঠার গল্প- “২০১৩ সালে মিরপুরের একটি মুদ্রা প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে এসে মুগ্ধ হন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি ‘টাকার জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে উদ্বোধন হলো ‘টাকার জাদুঘর’।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তলায় দুটি গ্যালারি দিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘরটি। ভিতরে ঢুকতেই আপনাকে আহ্বান জানাবে থরে থরে সাজানো টাকা, পয়সা, মুদ্রাগুলো। প্রতিটি যেন ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। এর সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য রয়েছেন গাইড। প্রথম গ্যালারিতে রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো ছাপা মুদ্রা। এ মুদ্রার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কতকগুলো প্রতীকের ছাপ। সাধারণ রুপা দিয়ে তৈরি এ মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। বাংলাদেশের মহাস্থানগড় ও নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া গেছে এ ধরনের অনেক মুদ্রা। টাকার এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে আরও অনেক দুর্লভ মুদ্রা। এখানে আছে গুপ্তযুগের মুদ্রা, গুপ্তযুগ-পরবর্তী বাংলার মুদ্রা, খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে নবম শতক পর্যন্ত হরিকেল রাজ্যে প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রা এবং প্রাচীনকাল  থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলায় ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে ব্যবহার করা কড়িসহ বিভিন্ন যুগের মুদ্রা। এ ছাড়া রয়েছে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রচলিত সব মুদ্রা।

বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশের মুদ্রা স্থান পেয়েছে এখানে। তিনটি চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার মুদ্রা বিনিময় ও সঞ্চয়ের পদ্ধতি। এখানে এক লাখ টাকার একটি নোটের ভিতরে চাইলেই যে কেউ নিজের ছবি জুড়ে নিতে পারেন। এ জন্য আপনাকে গুনতে হবে মাত্র ৫০ টাকা! টাকার জাদুঘরটিই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জাদুঘর। এখানে আরও প্রদর্শিত হচ্ছে খলিফাদের তৈরি করা মুদ্রা। দিল্লির সুলতানদের তৈরি করা মুদ্রা। বাংলার সুলতানদের তৈরি করা মুদ্রা। মুঘল শাসকদের তৈরি করা মুদ্রা। সারা পৃথিবীর সব স্বাধীন দেশের ব্যাংকনোট ও ধাতব মুদ্রা। একই সঙ্গে পৃথিবীর সব বিলুপ্ত দেশ, বিলুপ্ত জনপদের তৈরি করা ব্যাংকনোট, ধাতব মুদ্রা ও মুদ্রা তৈরি করার সব উপকরণ টাকার জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই টাকার জাদুঘরে প্রায় ৬০ জন দেশসেরা মুদ্রা সংগ্রাহক তাদের সংগ্রহ থেকে ধাতব মুদ্রা ও ব্যাংকনোট উপহার দিয়েছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সব স্মারক ১০ টাকার ধাতব মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ধাতব মুদ্রার মাস্টারমোল্ডও  দেখার সুযোগ রয়েছে জাদুঘরটিতে। টাকার জাদুঘরের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই নজরে পড়ে সেই ‘টাকার গাছ’ নামের শিল্পকর্মটি। ভবনের গায়ে গাছের মতো রূপ দেওয়া হয়েছে স্টিলের কাঠামো। সেই কাঠামোতে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ের মুদ্রার অনুলিপি। কাগুজে টাকাকেই যেহেতু আমরা ‘টাকা’ বলি, তাই সেই টাকাবিহীন মুদ্রাময় শিল্পকর্মকে মুদ্রা গাছও বলা যায়। বৃহস্পতিবার আর সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই খোলা থাকে জাদুঘরটি। নেওয়া হয় না কোনো প্রবেশমূল্যও। তবে অভ্যর্থনা কক্ষে নাম-ঠিকানা লিখে ভিতরে ঢুকতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুদ্রা ব্যবহারের বিবর্তনের ইতিহাসের সচিত্র উপস্থাপন যেন প্রথম গ্যালারির শো-কেসগুলো। প্রথম গ্যালারির প্রদর্শনী ঘুরে দেখা মিলল বাংলার প্রাচীন মুদ্রার ইতিহাস। টাকা রাখার থলেসহ টাকা বহন ও সংরক্ষণের নানা উপকরণ। টাকা রাখার থলেসহ টাকা বহন ও সংরক্ষণের নানা উপকরণ বিনিময়ের একাল-সেকাল প্রথম গ্যালারিটা ঘুরে দেখা গেল বাংলার হাজার বছরের বিনিময় প্রথার চিত্র। রেপ্লিকা বা ক্ষুদ্র সংস্করণে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ধানের বিনিময় হিসাবে নিচ্ছেন গরু। চালের বিনিময়ে মুরগি। পরেরটায় নদীর তীরে এক হাটে বেচাকেনা হচ্ছে পাট, তারও পরেরটায় উঠে এসেছে মানুষের সঞ্চয়ের চিত্র। বিশেষ এই প্রদর্শনীর নাম ‘বিনিময়ের একাল-সেকাল’। এই প্রদর্শনীর দেশ হিসেবে যুগোস্লাভিয়া নামটি এখন অতীত। যে দেশ ভেঙে জন্ম হয়েছে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া ও মন্টেনেগ্রো। এরপর মেসিডোনিয়া ও কসোভোর মতো দেশগুলো। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়া টিকে আছে টাকার জাদুঘরে, দেশটির মুদ্রার মাধ্যমে। বিশ্বের এমনই বিলুপ্ত কিছু দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রা রয়েছে এ জাদুঘরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর