মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত কমছে

গোলাম রাব্বানী

রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত কমছে

রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত কমাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সব স্তরে ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আরও ৫-১০ বছর সময় দেবে কমিশন। জানা গেছে, দল নিবন্ধনের তিনটি শর্তের প্রথম দুটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা। সে ক্ষেত্রে নিবন্ধন পেতে একজন সংসদ সদস্য ও ৫ ভাগ ভোট পাওয়ার বিধানটি আর থাকবে না। নতুন দল হিসেবেই কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটির দলিল দিয়ে নিবন্ধন পেতে হবে। এজন্য বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনা হচ্ছে।

এদিকে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য আলাদা আইন না করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশোধনী আনার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট করার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের জন্য আলাদা নিবন্ধন দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আরপিও থেকে একটি চ্যাপ্টার নিয়ে নিবন্ধন আইনের একটা প্রস্তাব রাখছি। এটা আলাদা আইন হবে কিনা তা সরকারের বিষয় ও সংসদ তা বিবেচনা করবে। কিন্তু আলাদা আইন না হলে বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা হয় বাদ দিতে হবে, না হয় সময় বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে সময় দেওয়ার পক্ষে কমিশন। অধিকাংশ দলই ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। বিশেষ করে সব স্তরে ৩৩% নারী রাখার কথা বলা হয়েছে। এখন কি দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে দেব আমরা? দলগুলোও আমাদের মত দিয়েছে সময় বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। গত এক যুগে তারা পূরণ করতে পারেনি। আমরা চাই আরও ৫ থেকে ১০ বছর সময় দেওয়া যেতে পারে।’ এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আগে ১২ বছর ছিল; এখন ছয় বছর হবে কিনা বা পাঁচ বছর নাকি ১০ বছর (২০২৫/২০৩০ সাল)- কত দিন সময় দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হবে তা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।’

পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট করার পরামর্শ : এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘আমাদের পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট নেই। তাই যে কেউ চাইলে একটা পলিটিক্যাল পার্টি খুলতে পারে। নির্বাচন কমিশন পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট করার জন্য সুপারিশ করতে পারে। আলাদাভাবে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট করবে। সে অনুযায়ী পলিটিক্যাল পার্টি গঠিত হবে এবং দল চলবে। এ ছাড়া অ্যাক্ট মোতাবেক যদি দল গঠিত হয় শুধু তারা আবেদন করবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন (রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিষয়) যদি রিভিউ করতে চায় তবে ওটা আলাদা না করে তারা পরামর্শ দিতে পারে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট করার জন্য। যেসব রাজনৈতিক দলকে প্রথমে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্টের অধীনে আসতে হবে। যে যার মতো আজকে আলাউন্স দিয়ে কালকে রাজনৈতিক দলের পতাকা নিয়ে রওনা হয়ে গেল। ওটা না করে অ্যাক্টের অধীনে যারা থাকবে তারা পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রেজিস্ট্রেশন নেবে।’ তিনি বলেন, ২০০৮ সালে প্রথম নিবন্ধনের বিষয়টি ছিল বলে ওই শর্তগুলো ছিল। এখন যাদের নিবন্ধন নেই তারা তো নির্বাচন করতে পারছে না। তাই নিবন্ধন শর্তের দুটির কোনো কার্যকারিতা থাকে না। তিনি বলেন, ‘এখন যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার জন্য নিবন্ধিত আছে, তারা তো আছেই। কিন্তু অন্যান্য ছোট ছোট দল আছে তারা তো এ পর্যন্ত আসতে পারছে না। তাই তাদের জন্য শিথিল করে হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আলাদা নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা দরকার। সেখানে ওই দলগুলো নির্বাচন করবে। নির্বাচন করার পরে রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে সংসদ নির্বাচনের জন্য তাদের উপযুক্ত করা হবে। আমি বলেছিলাম যদি উপজেলা নির্বাচনে সারা দেশে ২৫টি সিট তারা পায়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যদি ১০ ভাগ ভোট পায় তবে তাদের নিবন্ধনের জন্য উপযুক্ত মনে করা যেতে পারে।’ সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন থেকে বর্তমান কমিশনের দূরে থাকা উচিত। কেননা রাজনৈতিক দলগুলো এ আইন না করার বিষয়ে মত দিয়েছে। এ বিষয়ে তাদের কোনো ভূমিকা রাখা উচিত নয়। তারা পারলে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিষয়ে আইন করুক।’ তিনি বলেন, ‘যদি আইনের পরিবর্তন করতে হয় তবে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মতামত নিয়ে করা দরকার। যেভাবে বিগত ড. শামসুল হুদা কমিশন করেছিল সেভাবে করা দরকার। বর্তমান কমিশন যেটাই করছে সেগুলো জনস্বার্থবিরোধী কাজ। তাদের এসব কাজ থেকে দূরে থাকা উচিত। তারা কার স্বার্থে এসব করছে আমাদের কাছে তা বোধগম্য নয়।’ ভিতরে-বাইরে ‘সমালোচনা ও বিতর্কের’ মধ্যে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া গত ২৬ আগস্ট বুধবার অনুমোদন করেছে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি। এখন কমিশন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। পরে ভেটিং শেষে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন সাপেক্ষে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সংসদের সম্মতি পেলে তা আইনে রূপ পাবে। ১৯৭২ সালের আরপিও সংশোধন করে নবম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন প্রথা চালু হয়। এ এক যুগে দল নিবন্ধনে তিনটি শর্ত আরোপ করা হয়। এর মধ্যে একটি পূরণ করেই নিবন্ধন পেয়েছে সংশ্লিষ্ট দল।

দুটি শর্ত বাদ যাচ্ছে : দল নিবন্ধনে তিনটি শর্তের মধ্যে ১ ও ২ নম্বর শর্তের এখন প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী কমিশনের তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ হলে একটি দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়। ১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো জাতীয় নির্বাচনে দলটির অন্তত একজন যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন; ২. যে কোনো একটি জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী যদি অংশ নেওয়া আসনগুলোয় বাক্সে পড়া মোট ভোটের ৫ শতাংশ পান; ৩. যদি দলটির একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি থাকে এবং অন্তত ১০০ উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন থাকে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিবন্ধিত দলগুলো নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন করেছে। এক যুগ আগে ২০০৮ সালে নিবন্ধন পেতে ১ ও ২ নম্বর শর্ত কাজে লেগেছে। কোনো একজন সংসদ সদস্য বা ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়টি আগে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু এখন নিবন্ধিত দল ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ারই সুযোগ নেই, ভোটে অংশ না নিলে ৫% ভোট পাবে কীভাবে। সে ক্ষেত্রে দুটি শর্তের প্রয়োজন নেই। তৃতীয় শর্তটি বহাল রাখা হবে।’ তিনি জানান, আগামীতে কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলার কমিটি-সমর্থক তালিকাসংক্রান্ত শর্তটি পূরণ করেই নিবন্ধন আবেদন করা যাবে। নতুনদের জন্য এ বিধানই প্রযোজ্য।

সর্বশেষ খবর