রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

গাড়ি থাকলেই মনে করার কারণ নেই খাদ্য কেনার অর্থ আছে

আমেরিকার ক্ষুধার্ত মানুষ

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

অবিশ্বাস্য রকমের দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রে। করোনার তা-বে স্বল্প ও মাঝারি আয়ের পরিবারের পক্ষে চাহিদানুযায়ী খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ২৫/৩০ মাইল গাড়ি চালিয়েও অনেকে ত্রাণের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন অসহনীয় গরমের মধ্যে। তাদের কথা, ‘গাড়ি থাকলেই মনে করার কারণ নেই যে খাদ্য কেনার অর্থ আছে।’

গত ৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে এ রকম শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও। দেখা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ার সানদিয়েগো কাউন্টির অনেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে মাইলের পর মাইল গাড়ি চালিয়ে এক জায়গা থেকে খাদ্যের প্যাকেট সংগ্রহের পর আরেক জায়গায় যাচ্ছেন এবং পুনরায় লাইনে অপেক্ষা করছেন। অর্থাৎ যেখানেই ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে,    সেখানেই ছুটছেন তারা। কারণ একত্রে অনেক বেশি খাদ্য দেওয়া হয় না। এমন দৃশ্য ওরেগন, ওয়াশিংটন, মিশিগান, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, টেক্সাস, নিউজার্সি, ভার্জিনিয়া, পেনসিলভেনিয়া, নিউইয়র্ক, মিনিয়াপলিস, ক্যানসাসসহ সর্বত্র। করোনা-স্টিমুলাসের দ্বিতীয় ধাপের বিল নিয়ে রিপাবলিকানদের অমানবিক আচরণের খেসারত হিসেবে এমন কঠিন একটি পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হতে হয়েছে বিপুলসংখ্যক আমেরিকানকে।

জানা গেছে, বেকার ভাতা হিসেবে ফেডারেল সরকারের সাপ্তাহিক ৬০০ ডলার বন্ধ হওয়ার পর এখনো যারা কাজ পাননি, তারা মহাসংকটে রয়েছেন। বিশেষ করে যাদের বৈধ-কাগজপত্র নেই, তারা করোনার প্রকোপ কমা সত্ত্বেও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। গত এপ্রিলে বেকারের হার ছিল ১৪.৭ ভাগ, যা সবচেয়ে বেশি। তবে জুলাইতে তা কমে ১০.২ ভাগ হয়। আগস্টে আরও কমে ৮.৪ ভাগ হয়েছে। অর্থাৎ এক কোটিরও অধিক মানুষের কোনো কাজ নেই। তারা নিজ নিজ স্টেট থেকে সপ্তাহে ২/৩শ ডলার করে পাচ্ছেন বেকার ভাতা হিসেবে। এ দিয়ে খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করাই সম্ভব হচ্ছে না। এর ওপর রয়েছে বাসা ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট-টেলিফোন বিল। এপ্রিল থেকে আসছে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ি ভাড়ার জন্য কাউকে উচ্ছেদ করার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও পরবর্তীতে বকেয়া ভাড়া দিতেই হবে। সেটি তারা পাবে কোথায়- এমন দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে অনেক পরিবারকে। যেসব পরিবারে শিশু সন্তান রয়েছে তাদের সমস্যা আরও বেশি। শিশুর খাদ্য ক্রয় করতে হয় স্টোর/গ্রোসারি থেকে। ত্রাণসামগ্রী যারা বিতরণ করছেন তারা শিশুর জন্য আলাদা কিছু রাখেন না। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক হচ্ছে ‘ফুডস্ট্যাম্প’ কার্যক্রম। তবে অনেক স্টেটেই ফুডস্ট্যাম্প’র বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা কাটছাঁট করা হয়েছে। অথচ স্বল্প আয়ের লোকজনকে পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয়ের জন্যে ভর্তুকি হিসেবে ফুডস্ট্যাম্প চালু করা হয়েছে। ফুডস্ট্যাম্পের বরাদ্দ কমানোর ফলে গ্রোসারিগুলোও দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

এসব বিষয়ে একটি ত্রাণ বিতরণ স্থানের বিবরণ দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো নারী-পুরুষরা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে এসেছেন। পাশেই পার্ক করা হয়েছে গাড়িগুলো। মাইলেরও অধিক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা। প্রথম দর্শনেই অনুমান করা যায় প্রত্যেকের বিষণœতার কারণ। তারা কেউ স্বস্তিতে নেই। কেউ লজ্জাবোধ করছেন এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে। খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানোর কথা যারা কল্পনাও করেননি তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। একবেলা খাবারের প্যাকেটের কত যে গুরুত্ব কয়েক মাস আগেও তারা বুঝতে চাননি।

টাইমসে বলা হয়েছে, প্রায় প্রতিটি পরিবারের খাবার টেবিলেই এখন পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব। সবাই অস্বস্তিতে দিনাতিপাত করছেন। কবে নাগাদ এমন নাজুক পরিস্থিতির অবসান ঘটবে, সেটিও কেউ জানেন না। অনিশ্চিত জীবনযাপনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন যুবক-যুবতীরা। আগে যারা সপ্তাহে পাঁচ দিনই কাজ করেছেন, তাদের অনেকে কাজে ফিরতে সক্ষম হলেও কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলোর ২০/৩০ জন কর্মচারী ছিল, এখন তা অর্ধেক করা হয়েছে। মিসিসিপি স্টেটের জ্যাকসন সিটির একটি পরিবারের দুর্দশার বিবরণ দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। গত জুন থেকেই তারা সরকারি ত্রাণসামগ্রীর ওপর নির্ভরশীল। অথচ মার্চের আগের বছরে তাদের বার্ষিক আয় ছিল লাখ ডলারের বেশি। তারা নিজ বাসায় অবস্থান করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। ছুটি পেলেই আনন্দ-ভ্রমণে যেতেন। এমনই একজন টেনেসির এক মা। কাজ করেন কন্যাকে একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর জন্য। করোনায় স্কুল বন্ধ। নিজের কাজও হারিয়েছেন। এখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে অন্যের দয়া অথবা সরকারের ত্রাণ। ক্যালিফোর্নিয়ার কাজিমারো (৪০) তার শাশুড়ির বিউটি পার্লারে স্টাইলিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। একই সঙ্গে নিজ কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা দিতেন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে। করোনায় সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। কাজিমারোর স্বামী এডাম কাজ করতেন ফোর্ড গাড়ি বিক্রয় কেন্দ্রে কমিশনভিত্তিতে। সে ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। গাড়ি বিক্রি হয় না বলে কমিশনও পান না। করোনার ভয়াবহতা কিছুটা কমায় কাজিমারো এক বান্ধবীর ফার্মে থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করছেন জীবিকার স্বার্থে। কিন্তু সেখানেও কাস্টমার না থাকায় বেতন পাচ্ছেন না। ফলে কাজিমারোর দিন চলছে কোনোমতে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। যাকে কখনোই স্বাভাবিক কোনো ব্যবস্থা বলা যায় না। অথচ করোনার আগে তিনি স্বাবলম্বী ছিলেন, কারো দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়নি।

 

৭৪ বছর বয়েসী টেরি ম্যাকনামারা বলেন, ‘মহামন্দার যাত্রা শুরু হয়েছে মিনিভ্যানে’। তার কন্যা লোরা হর্সবার্গ এবং পাঁচ নাতি-নাতনিসহ একটি মিনিভ্যানে রাস্তা অতিক্রম করছেন আর দৃষ্টি প্রসারিত রেখেছেন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ হচ্ছে কি না। তার ভ্যান এগোচ্ছে আরও অনেক গাড়িকে অনুসরণ করে। সবাই ত্রাণের খোঁজে এগোচ্ছেন। ফুডব্যাংকের কাছে খাদ্য চাচ্ছেন অনেকে।

মেমফিসের ফুডব্যাংক মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৮ হাজার মানুষের মধ্যে নিয়মিত খাবার বিতরণ করেছে। মেমফিসে একটিমাত্র ফুডব্যাংক, তাই প্রয়োজনীয় সংখ্যক মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণে সক্ষম হচ্ছে না। এই ফুডব্যাংকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘নেইবারহুড ক্রিস্টিয়ান সেন্টার’র প্রেসিডেন্ট ইফি জনসন। তিনি বলেন, ৩০ বছর থেকেই ক্ষুধার্ত আমেরিকানদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করছি। কিন্তু এবারের মতো ব্যাপকতা কখনো দেখিনি। ফেডারেল সরকারের জরিপ অনুযায়ী, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ৩০ মিলিয়ন (৩ কোটি) আমেরিকান জানিয়েছেন যে, তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য পাচ্ছেন না। প্রতি তিনজন শিশুর একজনই পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে না বলেও সে সময় উদ্ঘাটিত হয়। গত দুই দশকের মধ্যে এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এখনো একই অবস্থা বিরাজ করছে বিভিন্ন সিটিতে। অর্থাৎ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে আমেরিকার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। চলতি গ্রীষ্মের পরিপূরক খাদ্য পাচ্ছেন না কমপক্ষে দুই কোটি আমেরিকান। বেকারভাতা নিয়ে কংগ্রেসের রশি টানাটানির অবসান না হলে ক্ষুধার্ত মানুষেরা কোন পর্যায়ে উপনীত হবে- তা নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের অভাবী মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছায় খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব পালনকারী একটি সংগঠনের নাম ‘ফিডিং আমেরিকা’। তারা এক গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ আমেরিকান খাদ্য সংকটে পড়বে। মার্চের তুলনায় তা ৪৬ ভাগ বেশি। তারা আরও বলছে, আগের তুলনায় বর্তমানে অভাবী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৬০ ভাগ। প্রতি ১০ জনের ৪ জন এবারই প্রথম তাদের কাছে বিনামূল্যের খাদ্য গ্রহণ করেছে।

সর্বশেষ খবর