মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

যুক্তরাজ্যে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা

রুহুল আমিন রাসেল

যুক্তরাজ্যের বাজারে ‘ধোলাইখাল-জিঞ্জিরা’ খ্যাত যন্ত্রাংশ তৈরির লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং বা হালকা প্রকৌশলশিল্প পণ্য রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোড থেকে গড়ে ওঠা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাগুলো এখন ছোট-বড় মেশিন তৈরি করছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে হচ্ছে রপ্তানি। চর্তুথ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। রপ্তানির সম্ভাবনা বিবেচনায় চলতি ২০২০ সালকে হালকা প্রকৌশলশিল্প বর্ষ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ প্রসঙ্গে হালকা প্রকৌশলশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিইআইওএ) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্বে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য রপ্তানির অন্যতম বাজার ইউরোপ। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সেখানে গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ রপ্তানি সম্ভব।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন জাপান ও জার্মানির বিকল্প মেশিন তৈরি করছে। তবু বলছি, আমাদের পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই। এখন আধুনিক প্রযুক্তি আনতে হবে। সে জন্য সরকারের নীতিসহায়তা দরকার। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বে ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের বাজার রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ এক শতাংশ রপ্তানি করতে পারলেও দাঁড়াবে ৭০ বিলিয়ন ডলার, যা পোশাকশিল্পকেও ছাড়িয়ে যেতে পারবে।’

এর আগে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম অতিসম্প্রতি ঢাকা চেম্বারের সেমিনারে বলেছেন, যুক্তরাজ্যে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিশাল বাজার রয়েছে এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সহজেই এ সুযোগ গ্রহণ করে আরও বেশি হারে পণ্য দেশটিতে রপ্তানি করতে পারেন। যদিও ব্রিটিশ বাণিজ্য সংগঠনগুলো বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বিষয়ে খুব বেশি অবগত নয়।

বিইআইওএর তথ্যমতে, বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ উৎপাদনশীল আর ৯০ শতাংশই সেবা ও মেশিন মেরামতের কারখানা। এতে প্রায় ৬ লাখ দক্ষ শ্রমিকের সঙ্গে অর্ধদক্ষ ১০ লাখ মিলিয়ে মোট কাজ করছেন প্রায় ১৬ লাখ শ্রমিক। প্রায় ১৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গড়ে ওঠা এই হালকা প্রকৌশলশিল্পের দেশীয় বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার আমদানিবিকল্প যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে এ খাত। আর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সেবার মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান রাখছে। বিশ্ববাজারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাত্র ৩১৯ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলারের ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হাওয়া এ শিল্পের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরের শুরুর দিনই চলতি ২০২০ সালে ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যকে জাতীয়ভাবে বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করে এ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। সম্ভাবনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এ শিল্পে বিনিযোগ আকর্ষণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বিনিয়োগ এবং সোর্সিংয়ের জন্য সর্বাধিক অনুকূল গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এ শিল্পের বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রপ্তানি সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা হবে। এ খাতের পণ্যের মধ্যে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোমোবাইল, অটো-পার্টস, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক, অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি, সোলার ফটোভলটিক মডিউল, খেলনা প্রভৃতি রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এ খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী। বিইআইওএ বলছে, ‘অর্থনীতিতে হালকা প্রকৌশলশিল্পের ওপর নির্ভর করে চীন, জাপান, তাইওয়ান ও কোরিয়ার উত্থান হয়েছে। আছে দেশি-বিদেশি বিশাল বাজার। এখন আমাদের প্রয়োজন নীতিসহায়তা। দরকার টেকসই পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপন। উদ্যোক্তাদের জন্য লাগবে নিরাপদ বিনিয়োগ ও অর্থায়নের নিশ্চয়তা।’ জানা গেছে, হালকা প্রকৌশলশিল্পকে মাদার ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়। মূলত কোনো খাতে শিল্প স্থাপন করার জন্য যেসব মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ প্রয়োজন হয়, তা উৎপাদন করে হালকা প্রকৌশল খাত। শিল্পকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও এ খাতেই উৎপাদিত হয়। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিপেয়ারিং ও সার্ভিসিংসহ পরিচর্যার কাজটিও করে হালকা প্রকৌশলশিল্প। আর জানা গেছে, বিশ্বে শিল্প উন্নয়ন ও প্রসারের ধারায় বাংলাদেশের নতুন নতুন শিল্প খাতের আবির্ভাব হয়। এর মধ্যে রয়েছে মুদ্রণশিল্প, নৌযান। হালকা প্রকৌশলশিল্পের একজন কারিগর দক্ষতার কারণে বিদেশে গিয়ে অদক্ষ কারিগরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করছেন। সব মিলিয়ে বহুবিধ কারণে হালকা প্রকৌশল খাত অপার সম্ভাবনাময় হিসেবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। জানা গেছে, দেশব্যাপী বিস্তৃত হালকা প্রকৌশল কারখানাসমূহ তিনটি পর্যায়ে উৎপাদন ও সেবা প্রদান করছে। এগুলো হলো, বিভিন্ন ধরনের শিল্পের মূলধনি মেশিনারি উৎপাদন, যানবাহন ও কল-কারখানার যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নিজ উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ শিল্প খাতের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া হালকা প্রকৌশল খাতের উদ্যোক্তারা এখনো শত বছরের পুরনো প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।

সর্বশেষ খবর