সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

শাঁখা শাঁখারি ও জরাজীর্ণ ভবনই শাঁখারীবাজার

মোস্তফা মতিহার

শাঁখা শাঁখারি ও জরাজীর্ণ ভবনই শাঁখারীবাজার

পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে জরাজীর্ণ ভবন -রোহেত রাজীব

বুড়িগঙ্গা নদীর কাছে ইসলামপুর রোড ও নওয়াবপুর রোডের সংযোগস্থলের একটি অংশজুড়ে আছে শাঁখারীবাজার। শাঁখারি, শঙ্খচূর্ণ ও সিঁদুর ব্যবসায়ীদের পেশার ওপর ভিত্তি করেই এই স্থানটির নামকরণ। হিন্দু অধ্যুষিত এ এলাকার মানুষদের প্রধান পেশাই হচ্ছে শাঁখা ও সিঁদুরসহ পূজার নানা অনুষঙ্গের ব্যবসা। ঢাকার শাঁখারিদের আবাসিক এলাকা শাঁখারীবাজার বহন করে চলেছে ঢাকাই ঐতিহ্যের অংশ। একদিকে শাঁখারিদের সরব উপস্থিতি ও ব্যস্ততা এ এলাকার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখলেও হাহাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানকার জরাজীর্ণ ভবনগুলো। তবে শাঁখারীবাজারের বাসিন্দারা জানান, এখানে ১৪২টি ভবনের মধ্যে দুই/চারটা ছাড়া বাকি সবই সংস্কার করা হয়েছে। আর যে কয়টি এখনো সংস্কার করা হয়নি সেগুলো নানা ধরনের আইনগত জটিলতায় আক্রান্ত রয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, যে ভবনগুলো সংস্কার করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে সেগুলো কোনো সংস্কারের পর্যায়েই পড়ে না। ভবন ভেঙে নতুন করে তৈরির পরিবর্তে পুরনো জরাজীর্ণ ভবনগুলোতে নতুন করে ইট ও ঢালাই দিয়ে দেখানো হয়েছে সংস্কার। ১১, ৪৭,৪৮,৫১, ৭৮/১,৮৭,৮৮,৯০ হোল্ডিং নম্বরের ভবনগুলোর দিকে তাকালেই এলাকার ভবনগুলোর করুণ চিত্র চোখে ভেসে উঠবে। আর ১৩৫ নম্বরের পুরনো তিনতলা মন্দিরের পুরোটাই যেন বিশাল বটবৃক্ষের ডালপালায় আচ্ছাদিত। পুরো মন্দিরটিকেই মনে হবে একটি বটগাছ। কোনো কোনো ভবনের বারান্দায় বানর ঝোলার দৃশ্যও লক্ষণীয় ছিল। যেন মানুষ আর পশুর একসঙ্গে বসবাস। ভবনগুলোর দিকে তাকালে এখানকার বাসিন্দাদের জীবন-যাপনের করুণ চিত্র ফুটে উঠলেও তা মানতে নারাজ তারা। যে কোনো স্থাপনা ও এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্যের বয়স ১০০ বছর পেরোলে সেটি প্রত্নতত্ত্বে ঠাঁই পায়। সে হিসেবে শাঁখারীবাজারকেও সরকার হ্যারিটেজ এলাকা ঘোষণা করেছিলেন। শাঁখারীবাজারকে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চালু হয়। এর আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার এবং পয়ঃনিষ্কাশনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু এলাকার বাসিন্দাদের আন্দোলনের মুখে হ্যারিটেজ ঘোষণা বাতিল করে সরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানান, হিন্দু সম্পত্তি ভোগ করার জন্যই হ্যারিটেজ নিয়ে কাজ করা আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর আলম এই এলাকাকে হ্যারিটেজ করার কাজে সরকারকে উসকে দিয়েছিল। হ্যারিটেজ ঘোষণার পর জরাজীর্ণ ভবনগুলোকে সংস্কার করে দেওয়ার কথা বলে এলাকার মানুষদের গৃহহীন করার ষড়যন্ত্র ছিল এটি। এমনটি জানালেন স্থানীয় তরুণ পলাশ দত্ত ও তারক রায় রানা। জরাজীর্ণ ভবন নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো সংবাদ প্রকাশ হোক এমনটিও চান না এখানকার বাসিন্দারা। তারা বলেন, জরাজীর্ণ ভবনের সংবাদ প্রকাশ করে সংস্কারের নামে সরকারকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। তাই গণমাধ্যমকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করে উল্টো গণমাধ্যমের বিষোদগারও করেন শাঁখারীবাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী।

শাঁখারীবাজারের বাসিন্দাদের মতে, শাঁখারীদের বাসগৃহ ও এর স্থাপত্য স্বতন্ত্র ধরনের। তাদের যে লাখেরাজ জমি দেওয়া হয়েছিল তা ছিল আয়তনে অনেক ক্ষুদ্র। সেই আয়তন মেনেই নির্মিত হতো বাসগৃহ। বাসগৃহের সামনের মূল ফটক হতো ছয় ফুটের মতো। এরপর বিশ-ত্রিশ ফুটের মতো লম্বা করিডর চলে যেত ভিতরে। দালানগুলো পেছনের দিকে বিশ গজের মতো প্রসারিত। যুগের পর যুগ চলতে থাকা এই ডিজাইনের পরিবর্তন না করেই তারা জরাজীর্ণ ভবনগুলো সংস্কার করেছেন এমনটিই এখানকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের দাবি। জেমস ওয়াইজের ১৮৮৩ সালের বর্ণনা অনুসারে ঢাকায় ওই সময় ৮৩৫ জন শাঁখারী বাস করতেন। ধারণা করা হয়, বল্লাল সেনের শাসনামলেই পূর্ববঙ্গে তাদের আগমন। সতেরো শতকে মুঘল শাসনামলে খাজনাবিহীন লাখেরাজ জমি প্রদান করে শাঁখারীদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তখন থেকেই এখানে তাদের বসবাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী শাঁখারীবাজার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর শাঁখারীরা নতুন করে এখানে আবারও বসতি গড়ে তোলেন। শাঁখারীবাজারে বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ বসবাস করছে।

সর্বশেষ খবর