মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় ভয়াবহতা বাড়ছে

৩৯ শতাংশই ঘটছে শর্টসার্কিটের কারণে, গত বছর ৮৬৪৪টি আগুনের ঘটনা

জিন্নাতুন নূর

বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় ভয়াবহতা বাড়ছে

ঢাকাসহ সারা দেশে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যে, দেশের মোট অগ্নিদুর্ঘটনার শতকরা ৩৯ শতাংশই ঘটছে বিদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দগ্ধ হয়ে প্রাণহানির প্রায় অর্ধেক ঘটছে বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনায়। বৈদ্যুতিক কারণে দুর্ঘটনার ঘটনা গত পাঁচ বছরে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ ধরনের দুর্ঘটনায় শুধু করুণ মৃত্যুই ঘটছে তা নয়, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির অঙ্গহানিও ঘটছে। ক্ষতি হচ্ছে বিপুল অর্থ-সম্পদের। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুর্ঘটনা রোধে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ এবং এসিসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে মোট ৮ হাজার ৬৪৪টি অগ্নিকা-  ঘটে, যা ছিল সে বছর মোট অগ্নিকান্ডের ৩৯ শতাংশ। এতে ক্ষতি হয় ২৩২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৬ টাকা। এ ছাড়া স্থির বিদ্যুতের কারণে মোট ১৩৩টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষতি হয় ৬৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে আগুন লাগার ঘটনাগুলো সাধারণত অফিস, মার্কেট, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই বেশি ঘটে। আর বাসাবাড়ি ও কর্মস্থলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অসাবধানতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। বৈদ্যুতিক অগ্নিকান্ডের অন্যতম কারণ ওভারলোডিং ও শর্টসার্কিট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্রাহকরা যে সকেট, মাল্টিপ্লাগ ও এসি ব্যবহার করছেন সেগুলো তারা কম দামে কিনছেন। এগুলোর গ্যারান্টিও থাকে না। আর নিম্নমানের এই পণ্যের কারণে শর্টসার্কিট, এসি বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। দেখা যায়, প্রতিবছর শীত শেষ হলে মানুষজন এসি ব্যবহার শুরু করেন। কিন্তু ব্যবহারকারীদের অনেকেই এই যন্ত্রটি প্রতিবছর সার্ভিসিং করান না, যা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। যেহেতু এখন নতুন নতুন শিল্প-কারখানা  তৈরি আর সেখানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে, যা কিনা বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, সেখানেও দুর্ঘটনাগুলোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

২০০৩ সালের অগ্নিনির্বাপণ আইন অনুযায়ী, ছয়তলার ওপর কোনো ভবন অথবা কোনো শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক কারখানা, অফিস নির্মাণ করতে হলে এর অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে।  দেশে যেহেতু ২০০৩ সালের আগে এ সংশ্লিষ্ট কোনো আইন ছিল না এ জন্য কেউ তখন ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সেফটি মানেননি। অর্থাৎ ২০০৩ সালের আগে যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল সেগুলো ফায়ার সেফটি  ছাড়াই নির্মাণ করা হয়। আবার বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে অগ্নি সুরক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত দেওয়া আছে। আর এটি তৈরি হয় ২০০৬ সালে। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার ভবনগুলো অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে তৈরি করা হয়নি। আর এই ভবনগুলোতে বৈদ্যুতিক কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নব্বইয়ের দশকে ঢাকার যে ভবনগুলো তৈরি করা হয়, তা শুধু ফ্যান ও লাইট চালানোর উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল। তখন ঘরে ঘরে এখনকার মতো এসি ছিল না। অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে ভবনের যে ওয়্যারিং সিস্টেম করা হয়, তা ফ্যান ও লাইট চালানোর মতো উপযোগী করে তৈরি করা হয়। কিন্তু এখন ঘরে ঘরে এসি লাগানোয় ক্ষমতার অতিরিক্ত লোড নিতে হচ্ছে পুরনো সেই ওয়্যারিং সিস্টেমকে, যা থেকে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘ পেশাজীবনে বহু পোড়া রোগী দেখেছি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের অগ্নিদুর্ঘটনার মতো একসঙ্গে এত আশঙ্কাজনক অবস্থার পোড়া রোগী আর দেখিনি। এই রোগীদের পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ পোড়া রোগীর তুলনায় বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডে পোড়া রোগীর ক্ষত অনেক বেশি। পাঁচ বছর ধরে লাখ করে দেখছি, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দুর্ঘটনার ঘটনা খুব কমন হয়ে গিয়েছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বিস্ফোরিত হচ্ছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে একটি নির্দিষ্ট আইন করতে হবে। বছরে বছরে কেউ যদি এসি সার্ভিসিং না করান, তাহলে তার যন্ত্রটি বাতিল বা জরিমানা করার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ঘটনা রোধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়া, সাধারণ মানুষ- সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর