বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মহামারীতে বাল্যবিয়ে বেড়েছে দুই গুণ

উপকূলীয় ও উত্তরাঞ্চলে বেশি বাল্যবিয়ে, দরিদ্রতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, কম খরচে ও যৌতুক ছাড়া বিয়ে দিতেই এ পন্থা

জিন্নাতুন নূর

মহামারীতে বাল্যবিয়ে বেড়েছে দুই গুণ

করোনাভাইরাস মহামারীতে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে দুই গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মা-বাবা অনেকটা নীরবে লুকিয়ে কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কিছু বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেলেও বেশির ভাগই আটকানো যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামেই বেশি বাল্যবিয়ে ঘটছে। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত জেলা এবং উত্তরাঞ্চলে বেশি ঘটছে বাল্যবিয়ে। এ ক্ষেত্রে ভোলা, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলা এগিয়ে। বিশেষজ্ঞরা জানান, দরিদ্র পরিবারের দৈনিক উপার্জন কমে যাওয়া, শহর থেকে অনেক পরিবারের গ্রামে স্থানান্তর হওয়া, অসচেতনতা, কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা দিতে না পারা, মহামারীতে কম খরচে ও যৌতুক ছাড়া বিয়ে দেওয়ার জন্য অভিভাবকরা সন্তানকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।

ছদ্মনাম লাবণ্য আক্তার (১৬)। কুমিল্লার এ কিশোরী জুনের প্রথম দিকে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকাতে চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এ ফোন দিয়ে সাহায্য চায়। কিশোরীটিকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। লাবণ্য হেল্পলাইনে জানায়, গ্রামবাসী তার বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করার পরও পরিবার তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। সে-যাত্রায় লাবণ্যকে স্থানীয় প্রশাসন বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। জানা যায়, করোনা সংক্রমণের কারণে কিশোরীর বাবার উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কঠিন সময় পার করছিল তাদের পরিবার। এজন্যই মেয়েটির বিয়ের আয়োজন। জানা যায়, সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। প্রতিটি উপজেলায় চাইল্ড হেল্পলাইনের মোবাইল টিম আছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংস্থাটির কর্মীরা কাজ করছেন। এ ছাড়া সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এ হেল্পলাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছে। চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জানা যায়, এ সাহায্যকারী সংস্থার কাছে বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত ফোনকলের সংখ্যা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক পরিবারই করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এসব কারণে মহামারীতে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার করোনাকালে দেশে অনেক প্রবাসী অবিবাহিত যুবক ফিরে এসেছেন। তারাও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের বিয়ে করেছেন।

হেল্পলাইনের ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহাইমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে চাইল্ড হেল্পলাইনে বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত ৪৫০টি ফোনকল আসে। অথচ মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৩২২। তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে আমরা বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত ১০০টি কল পেতাম, এখন সেখানে ১৮০টি ফোন পাচ্ছি।’ বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তালিকায় থাকা বিশ্বের প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি। ইউনিসেফের তথ্যে, এ দেশের ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে ১৮ বছরের আগেই হচ্ছে। আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের  আগে। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ৫৭ হাজার নারী-শিশুকে ফোন দিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে বলা হয়, চলতি বছরের জুনে ৫৩টি জেলায় ৪৬২টি বাল্যবিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। নারীনেত্রী ও সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মালেকা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মহামারীর এই সময়ে ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। কারও সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারছি না। কারও কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি না। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব ও নিরাপত্তার আহ্বানই করতে থাকি, তাহলে করোনার সময় বাল্যবিয়ে রোধ করা কঠিন। আবার বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে নারী সংগঠনগুলোও আন্দোলন করছে না, যা বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ। তাই যে মা-বাবারা তাদের কন্যার বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন শুধু তাদের একা দায়ী করতে পারছি না। দুঃখজনক হলেও আমি নিজেও এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছি না। অন্য নারীনেত্রীরাই বা কেন প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন না তা স্পষ্ট নয়। অবশ্যই এ ধরনের কর্মকা- বন্ধে আমাদের আহ্বান জানাতে হবে। শুধু বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে কথা বলাই যথেষ্ট নয়, ভুক্তভোগী মেয়েটিকে শিক্ষা ও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর