বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ইতিহাসের পিদিম জ্বালিয়ে চলছে কুড়িগ্রামের উত্তরবঙ্গ জাদুঘর

খন্দকার একরামুল হক সম্রাট, কুড়িগ্রাম

ইতিহাসের পিদিম জ্বালিয়ে চলছে কুড়িগ্রামের উত্তরবঙ্গ জাদুঘর

নদীবেষ্টিত কুড়িগ্রামের প্রকৃতিকে বিবেচনায় নিলে এ এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভূরুঙ্গামারী থেকে রাজীবপুর প্রায় শত মাইল নদ-নদীর কোল ঘেঁষে থাকা সারি সারি পাহাড়ের সঙ্গে মেঘদের মেলা পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্যকে হার মানাতে পারে। ভরা পূর্ণিমায় ধরলা-ব্রহ্মপুত্রে আছড়ে পড়া জ্যোৎস্নার ঢেউ অনেক সাহিত্য সৃজনের উৎস। সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ^রী কিংবা আব্বাস উদ্দিনের ওকি গাড়িয়াল ভাই এ প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত। কুড়িগ্রামই একমাত্র জেলা যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয় নামক তিনটি রাজ্যের সীমান্ত। এরকম একটি জেলাতেই মহান একাত্তরে দুটি সেক্টরের নাভিমূল ছিল। ছিল নৌকমান্ডোদের কার্যক্রমও। অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহ লড়াই সংগ্রামের পীঠস্থান এ জেলা। তেভাগা থেকে তোলাগন্ডী , দেবী চৌধুরানী থেকে ভবানী পাঠক, নূরলদীন থেকে নমরুদ্দিন সবাই এ অঞ্চলের মানুষ। ব্রিটিশ থেকে বাষট্টি, ছয় দফা থেকে একাত্তর সব লড়াইয়ে শামিল ছিলেন তারা। বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে একাত্তরে গড়েছিলেন মহা-লড়াই। এখানেই ছিল সবচেয়ে বড় মুক্তাঞ্চল। ছিল নানামুখী কর্মযজ্ঞ। এ জেলায় যেমন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল লড়াই, তেমনি ছিল প্রবল প্রতাপশালী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। একাত্তরে এখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের দারুণ দৌরাত্ম্য ছিল। তারা সিভিল ও সামরিক প্রশাসনের প্যারালাল হয়ে উঠেছিল। তাদের অত্যাচারের কাহিনি এখনো গা শিউরে তোলে।

খ্যাতনামা আইনজীবী এস এম আব্রাহাম লিংকন সেই অবহেলিত মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের ওপর ভর করে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সংগ্রহশালা, যার নাম দিয়েছেন তিনি ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’। পৃথক একটি জাদুঘর ভবন নির্মাণের সামর্থ্য না থাকায় নিজের বসতবাড়িতেই এটি গড়ে তোলেন তিনি। মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তোলা তার বাড়িটিই আজ ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’ হিসেবে পরিচিত। এ জাদুঘরে স্বাধীনতাবিরোধীদের নানা কর্মকান্ডের অসংখ্য দুর্লভ দলিল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, হিন্দু সম্পদ দখলে নেওয়ার আবেদন, রাজাকারে যোগদানের আবেদনপত্র। জাতীয় জাদুঘরের পরিভ্রমণ টিমের প্রধান ও কিপার ড. গোলাম হায়দারের মন্তব্য, ‘এর সংগৃহীত স্মারকসংখ্যা জাতীয় জাদুঘর ও আহসান মঞ্জিলের পর অবস্থান করবে।’ এই জাদুঘরে যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা স্মারক রয়েছে।

সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলতে না পারলেও এই জাদুঘরের স্মারকসমূহ আব্রাহাম লিংকন দুই দশকের অধিক সময় ধরে সংগ্রহ করেছেন। এই জাদুঘরটিতে আঞ্চলিক ঐতিহ্য থাকলেও এর প্রধান বিষয়ই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। এই জাদুঘরের অবস্থান কুড়িগ্রাম জেলা শহরের নতুন শহরে। কুড়িগ্রামের মতন প্রান্তিক জেলাতে হলেও এটি সমগ্র দেশের মানুষের জন্য একটি সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালাটি দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা নিয়মিত আসেন। এখানে বিভিন্ন্ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণে মুখরিত থাকে। প্রথমদিকে এটি সপ্তাহে এক দিন শনিবার খোলার কথা থাকলেও এখন পর্যটকদের কারণে প্রতিদিনই খোলা থাকে। এমনকি রাত-বিরাতেও অনেক দর্শনার্থী পরিভ্রমণ করেন। আব্রাহাম লিংকনদের বাসার সব কক্ষেই রয়েছে জাদুঘরের সামগ্রী। প্রতিটি কক্ষেই জাদুঘরের ডিসপ্লে। করোনাকালে সংখ্যা কমলেও এযাবৎ প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এটি পরিভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী কে এম খালিদ, সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিত্ব, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাষ্ট্রদূত, শিক্ষক, বরেণ্য সংস্কৃতিজন ছাড়াও বহু শ্রেণি-পেশার মানুষ।

আব্রাহাম লিংকনকে জিজ্ঞেস করা হয়, এই বাড়িটি তিনি জাদুঘর করবেন বলে নির্মাণ করেছেন কি না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটি নিজের বসবাসের জন্য তৈরি করেছি। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় এবং সহযোগিতা না পাওয়ায় দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বোধ থেকে নিজেদের বাড়িতেই সংগৃহীত স্মারক প্রদর্শনী শুরু করি। শুরুটা বৈঠকখানা দিয়ে হলেও এখন বাড়ির সব কক্ষেই এর ডিসপ্লে। এটি ক্রমান্বয়ে মহিরুহ রূপ ধারণ করেছে। যখন ঘুমাই তখন এটি বাড়ি। যখন জেগে থাকি তখন এটিই জাদুঘর।’ জায়গার অভাবে শয়নকক্ষেও বিভিন্ন সংগ্রহ রেখেছেন। প্রথম দিকে স্কুলশিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। এখন তারা নিজ উদ্যোগেই দেখতে আসে। কুড়িগ্রাম জেলার কৃতী সন্তান সব্যসাচী লেখক প্রয়াত সৈয়দ শামছুল হক ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’ পরিদর্শন করেছেন। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক তার বেশ কিছু সামগ্রী এ জাদুঘরে দিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হকের কফিন, কুড়িগ্রামের সন্তান বীরপ্রতীক তারামন বিবির অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী অনেক দলিল ও হিন্দুদের যুদ্ধকালীন জমি দখলসহ নানা দস্তাবেজ রয়েছে এখানে। এ ছাড়া শান্তি কমিটির যে মিটিং, তার রেজুলেশন ও হাতিয়া গণহত্যাসহ নানাজনের মামলা-মোকদ্দমার নানা তথ্য রয়েছে এ জাদুঘরে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তৃণমূল কর্মীকে লেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কুড়িগ্রামের শহীদ জায়া-জননীদের যে চিঠি ও চেক দিয়েছেন সেগুলো রয়েছে এখানে। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রথম আদালত রৌমারীর আদালতের প্রামাণিক দলিল ছাড়াও রয়েছে ছিটমহলের দলিল-দস্তাবেজ। গবেষকেরা বিলুপ্ত ছিটমহল নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন এ জাদুঘরের দলিলাদি নিয়ে। এমনকি ভারতের ছিটমহলেরও অনেক তথ্য রয়েছে এখানে। জাদুঘরটির ছিটমহল-সংক্রান্ত একটি পৃথক ভবন বা কর্ণার হতে পারে। এটিকে পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরে রূপ দিতে আব্রাহাম লিংকন প্রধানমন্ত্রীর সদয় সহযোগিতা চান। এ ব্যাপারে লিংকনপত্নী অধ্যাপক নাজমুন নাহার সুইটি বলেন, ‘পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য বিনষ্ট হলেও এই বাড়িটিই আমরা জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। আমাদের পারসোনাল বলতে এখানে কিছু নেই। আমরা দুজন মিলে এর সবকিছু সংরক্ষণ করছি। এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সবাই যখন এসে দেখেন মুক্তিযুদ্ধের এসব দলিলাদি, তখন খুবই আনন্দ লাগে।’

এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এ জাদুঘরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন তাহলে এটিকে পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরে রূপ দেওয়া সম্ভব। যেমন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সরকার জমি দিয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, টাকা দিয়েছে, অনুরূপভাবে এটিকেও পারে সহযোগিতা করতে। কোনো মন্ত্রণালয় যদি এককভাবে নাও পারে, সম্মিলিতভাবে এর সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে।’

সর্বশেষ খবর