রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

চতুর্থ দফা বন্যার কবলে দেশ

মুহূর্তে নদীগর্ভে মসজিদ, বিপৎসীমার ওপরে ৩ নদী

নিজস্ব প্রতিবেদক

চতুর্থ দফা বন্যার কবলে দেশ

নদীগর্ভে এভাবেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি আবাদি জমি স্থাপনা। ছবিটি লালমনিরহাটের ইশোরকুল এলাকা থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিন মাসের মধ্যে দেশে চতুর্থ দফা বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এক দিনের ব্যবধানে আরও একটি নদী বিপৎসীমা অতিক্রম করায় গতকাল তিনটি নদী চারটি পানি সমতল স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে বগুড়া, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চতুর্থ দফা বন্যায় ফের ডুবে গেছে আমন ধানসহ শীতকালীন আগাম সবজির খেত। সেই সঙ্গে আগ্রাসী তিস্তা ও যমুনার ভাঙনে প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, এক দিনের ব্যবধানে গতকাল সকাল ৯টায় কুড়িগ্রামে ধরলার পানি ১৯ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যমুনার পানি বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে ৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ও সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নাটোরের সিংড়ায় গুড় নদীর পানি এক দিনে ২৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৫৩টিতে পানি বেড়েছে। কমেছে ৪৭টিতে ও অপরিবর্তিত ছিল একটি স্টেশনের পানি। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমছে, বাড়ছে যমুনার পানি। গঙ্গার পানি স্থিতিশীল  রয়েছে, বাড়ছে পদ্মার পানি। তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে।

দেড় মাসব্যাপী বন্যার পর গত ২৯ আগস্ট দেশের সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নামে। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও উঁচু সড়কে আশ্রয় নেওয়া বানভাসিরা ফিরে আসেন বন্যায় বিধ্বস্ত বসতভিটায়। ফসল হারানো কৃষক ধার-দেনা করে ফের আবাদ শুরু করে। ১৭ দিন বন্যামুক্ত থাকার পর ১৫ সেপ্টেম্বর বিকালে ফের বিপৎসীমা অতিক্রম করে ধরলা। প্লাবিত হয় লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চল। চার দিনের মাথায় গতকাল বিপৎসীমা অতিক্রম করে তিনটি নদী। এতে পাঁচটি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও খবর- সিরাজগঞ্জ : বন্যা-বৃষ্টি ও ভাঙনে নাকাল হয়ে পড়েছে সিরাজগঞ্জের যমুনা তীরবর্তী মানুষেরা। টানা বন্যায় নষ্ট হওয়া ঘরের টিন-বেড়া, আসবাসপত্র মেরামত করার আগেই ফের যমুনার পানি বাড়তে শুরু করেছে। চতুর্থ দফা পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল আবারও প্লাবিত হয়ে পড়েছে। শত শত বসতভিটায় পানি উঠতে শুরু করেছে। আবারও বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে অনেক পরিবার। পানি নেমে যাওয়ায় কৃষকের নতুন করে রোপণ করা ফসল ফের তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে, পানি বাড়ায় যমুনার অরক্ষিত অংশে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে শত শত বসতভিটা ও ফসলি জমি। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে চৌহালী-শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরের নদী তীরবর্তী মানুষের। গতকাল দুপুর ১২টায় সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সিমলা এলাকায় হঠাৎ তীব্র ভাঙন শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্য শত শত মানুষের চোখের সামনে একটি পাকা মসজিদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙনের দৃশ্যটি দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। ফের ভাঙন শুরু হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে পাঁচঠাকুরীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ। স্থানীয়রা বলছেন, গত ২৪ ও ২৫ জুলাই ভয়াবহ ভাঙনে সিমলা স্পার ভেঙে এলাকার তিন শতাধিক বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

 সবকিছু হারিয়ে এসব মানুষ ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিওব্যাগ ডাম্পিং করলেও তা কোনো কাজে আসছে না। বর্তমানে ভাঙনের মুখে রয়েছে হাজার হাজার বসতভিটা ও ফসলি জমি। লালমনিরহাট : আগ্রাসী তিস্তার ভাঙনে গত চার-পাঁচ দিনে বিলীন হয়েছে লালমনিরহাটের একটি গ্রামের ৯৪টি পরিবারের ঘরবাড়ি, ঈদগাহ ও ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়েছে বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা। জেলার পাঁচটি উপজেলায় ভাঙন দেখা দিলেও কয়েক দিন ধরে তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাপাড়া। নদীগর্ভে চলে গেছে ঐতিহ্যবাহী আহলে হাদিস ঈদগাহ মাঠ। গত দুই দিনে গ্রামটির ৩৫টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে গোবর্ধন ইসমাইল পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙন ঠেকানো না গেলে দুই-এক দিনের মধ্যেই গ্রামটির একমাত্র বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে হারিয়ে যেতে পারে। এমনকি দ্রুত ভাঙন রোধে ব্যর্থ হলে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটিও (ওয়াপদা বাঁধ) বিলীন হতে পারে। সিঙ্গিমারী, পাসাইটারী গ্রামটি বিলীন হওয়ায় তিস্তা নদীর পানি এখন ধাক্কা দিচ্ছে ওই বাঁধে। বাঁধটি নদীগর্ভে চলে গেলে শত শত একর জমি অনাবাদি হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে ভাঙনের মুখে পড়বে কয়েক হাজার পরিবার ও সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু স্থাপনা। স্থানীয়দের মতে, তিস্তা নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় অল্পতেই বন্যা আর ভাঙনের মুখে পড়ছে তিস্তাপাড়ের মানুষ।

বগুড়া : সারিয়াকান্দি উপজেলার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদী তীরবর্তী নিচু এলাকার আমন ধান, শাক-সবজি ও চরাঞ্চলের কৃষকের আউশ, মরিচ, রোপা আমন, বীজতলা, শাক-সবজি ও গাইনজা ধানের আবাদ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। যেসব এলাকা এখনো প্লাবিত হয়নি, সেখানকার কৃষকদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, গতকাল সকাল ৬টায় যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকাল থেকে কমতে শুরু করে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে পানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর