মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

নারী মাদকাসক্ত পাঁচ বছরে বেড়েছে ৯ গুণ

পুরুষের তুলনায় নারীর ক্ষতি বেশি

জিন্নাতুন নূর

ত্রিশোর্ধ্ব সুমি (ছদ্মনাম) ২৫ বছর বয়সে তার দীর্ঘদিনের বন্ধুকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে কলেজে পড়া অবস্থাতেই সুমি তার স্বামীর সঙ্গে মাদক নিতেন। বিয়ের পর সুমির মাদক গ্রহণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে স্বামীর সঙ্গে বনিবানা না হওয়ায় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। বিচ্ছেদের পর সুমি মা-বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। অভিভাবকরা সুমিকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। সুস্থ জীবনে ফেরার জন্য শুরু হয় সুমির লড়াই। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই সুমির মতো আরও অনেক নারী মাদকের নীল জালে জড়িয়ে পড়েছেন। আশঙ্কাজনক হলেও, দেশে গত পাঁচ বছরে নারীদের মাদকদ্রব্য গ্রহণের হার প্রায় ৯ গুণ (৮.৯২) বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনায় এটি জানা যায়। সংশ্লিষ্ট মহল বলছেন, পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইসিডিডিআরবি জার্নাল অব হেলথ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশনের এক জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীর ৭৯.৪ শতাংশ মাদকাসক্ত পুরুষ আর ২০.৬ শতাংশ নারী। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১৪ সালে সরকারি পর্যায়ে (বহির্বিভাগ) চিকিৎসাপ্রাপ্ত নারী রোগীর সংখ্যা ছিল ২৫ জন। ২০১৫ সালে ৩ জন, ২০১৬ সালে ১৬ জন, ২০১৭ সালে ২৮ জন, ২০১৮ সালে ৯১ জন এবং ২০১৯ সালে ৩৬০ জন। আর অন্তর্বিভাগে ২০১৪ সালে ১ জন, ২০১৫ সালে কোনো রোগী ছিল না, ২০১৬ সালে ৪৭ জন, ২০১৭ সালে ৭৪ জন, ২০১৮ সালে ৮০ এবং ২০১৯ সালে ২২৩ জন নারী চিকিৎসা নেন।

ঢাকা আহছানিয়া মিশনের এডিকশন ম্যানেজমেন্ট ইনট্রিগ্রেটেড কেয়ারের (এএমআইসি) তথ্যে, পুরুষদের দিয়ে শুরু হলেও নারী মাদকাসক্তের সংখ্যাও এখন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এএমআইসির তথ্যে, গত তিন বছরে এই প্রতিষ্ঠানে ২৫০ জন নারী মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশই পারিবারিক কলহ থেকে সৃষ্ট কারণে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীরা মাদক গ্রহণ করেন। অবিবাহিতদের মধ্যে বড় অংশই শিক্ষার্থী। আর ত্রিশোর্ধ্ব মাদকাসক্ত নারীরা সাধারণত বিবাহিত হন। মেয়েশিক্ষার্থীরা সাধারণত ইয়াবা, গাঁজা ও স্লিপিং পিল বেশি নেন। আর ত্রিশোর্ধ্ব নারীরা স্লিপিং পিল ও ইয়াবা গ্রহণ করেন। এর পাশাপাশি নারীরা হেরোইন ও সিগারেটও মাদক হিসেবে ব্যবহার করেন। মূলত পরিবারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং পরিবারের অন্য মাদকাসক্তের উৎসাহে নারীরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাদক গ্রহণের ফলে পুরুষের তুলনায় নারীর ক্ষতি বেশি হয়। যেহেতু নারীর শারীরিক ঝুঁকি পুরুষের চেয়ে বেশি আবার বাংলাদেশে মেয়েদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও খুব দুর্বল থাকে, এ জন্য নারী মাদকাসক্ত অনেকে অপুষ্টিতে ভোগেন। আবার মাদক গ্রহণের কারণে মানসিকভাবেও নারীরা খুব বিষণœ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া মাদক গ্রহণের ফলে নারীরা এইচআইভি, যকৃতের সমস্যায় ভোগেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুরুষের পাশাপাশি বর্তমানে নারীর মাদকাসক্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক সংকট অন্যতম। তবে সারা দেশে আমরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছি। এতে মাদকের ব্যবহার কমে আসবে বলে আশা করছি।’

ঢাকা আহছানিয়া মিশনের ফিমেল ড্রাগ ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের প্রোগ্রাম অফিসার উম্মে জান্নাত বলেন, ‘সমাজের সব শ্রেণির নারী মাদকাসক্তরা আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছেন। সাধারণত পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে থাকলে ভুক্তভোগী নারীরও মাদক গ্রহণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক সংকটময় পরিস্থিতির কারণে অনেক নারী মাদক নিচ্ছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৩০টি শয্যার মধ্যে ২৫টিতেই এখন রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের প্রতিদিন কাউন্সেলিং করানো হয়। ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, বিশ্বায়নের এই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছেলেমেয়েদের মাদকাসক্তির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর যে ছেলেমেয়েদের অভিভাবকদের প্যারেন্টিং স্কিল দুর্বল তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কিছু ক্ষেত্রে যে পরিবারগুলো অশান্তি নিয়ে কাজ করে সেখানে শিশুরা ঠিকমতো বড় হয়ে উঠছে না। এসব পরিবারের কন্যাশিশুদেরও মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। একটি ছেলে মাদক গ্রহণের পরও সমাজে যেভাবে মিশে যেতে পারে একটি মেয়ে সেভাবে পারে না। তাকে সেভাবে কেউ সাহায্য করে না। লক্ষ্য করা গিয়েছে, যেসব মেয়ে মাদক গ্রহণ করে তারা অর্থ সংগ্রহ করতে অনেক সময় বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে মাদক গ্রহণের জন্য মেয়েদের অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ করতেও দেখা যায়।

সর্বশেষ খবর