শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যা ও ঝড়বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন

নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিতে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল, বন্দরে সতর্কসংকেত, ফের পানিবন্দী শত শত পরিবার, রাস্তাঘাট তলিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন, ভাঙনে বিলীন ঘরবাড়িসহ স্থাপনা, বিপৎসীমার ওপরে বিভিন্ন শাখা নদীও

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যা ও ঝড়বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন

রাস্তা পানিতে ডুবে যাওয়ায় কলার ভেলায় করে যাতায়াত। ছবিটি লালমনিরহাটের চর রাজপুর থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিরামহীন ভারি বৃষ্টিপাত, উজানের ঢল আর অব্যাহত ভাঙনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি আবারও দ্রুত বাড়ছে। টানা বৃষ্টি ও নদীর পানি বৃদ্ধিতে প্লাবিত হয়েছে এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল। তীব্র নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি ও বিভিন্ন স্থাপনা। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে বিরাজ করছে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। জোয়ারের পানি বেড়ে প্লাবিত অনেক এলাকা। দিনভর বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ। লঘুচাপের কারণে সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর ও নদীবন্দরে ১ নম্বর বিপদসংকেত জারি করা হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সকালে নাটোরের সিংড়ায় গুড় নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ সময় অন্য কোনো নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে না থাকলেও সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ কুলাঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ধরলার পানি। বিপৎসীমা অতিক্রম করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন শাখা নদীও। সংস্থাটির গতকাল সকালের পূর্বাভাসে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মার পানি হ্রাস পাচ্ছে। তবে কুশিয়ারা ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতীয় অংশে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার এবং আপার মেঘনা অববাহিকার সব প্রধান নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে।

এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে এবং গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। রংপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও তথ্য- বরিশাল : লঘুচাপের কারণে গত মঙ্গলবার থেকে দক্ষিণাঞ্চলে বিরামহীন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। অব্যাহত বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বরিশাল নগরীর বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে আরও দু-এক দিন বৃষ্টি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। ঝালকাঠি : লঘুচাপ ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল সকাল থেকে নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চলের অন্তত ২০টি গ্রামের বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনায় পানি ঢুকে পড়েছে। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে জোয়ারের পানিতে শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঝালকাঠি পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সাজেদুল বারী জানান, স্বাভাবিকের চেয়ে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে দুই-তিন ফুট পানি বেড়েছে। পাশাপাশি টানা বৃষ্টিতে পানি জমে দুর্ভোগ বেড়েছে। বিষখালী নদীর ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে কাঁঠালিয়া ও রাজাপুর উপজেলার নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোতে। এ ছাড়াও নলছিটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বসতঘর, ফসলের খেত ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। রংপুর : ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার পানি বেড়ে ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলায় চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আবারও শত শত পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চরের বাড়িগুলোর চারপাশে শুধুই পানি। হঠাৎ করে আসা পানিতে বাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেকের ঘরে হাঁটু কিংবা কোমর পানি ওঠায় চুলা জ্বালাতে পারেনি চরের পরিবারগুলো। কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহরাব আলী জানান, তিনি ভোরে পানিবন্দী এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ সহায়তার জন্য পানিবন্দী পরিবারের তালিকা তৈরি করছেন। লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল হাদী জানান, তিনি রাত থেকে শংকরদহ ও বাগেরহাট এলাকার লোকজনকে নিয়ে ভাঙন রোধে কাজ করছেন। পানির স্রোতে তার এলাকায় ৯০টি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বলেন, বৃষ্টিপাত ও উজানের পানি আসা অব্যাহত থাকলে তিস্তার পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কুড়িগ্রাম : গত তিন দিন ধরে জেলার সবা নদ-নদীর পানি কমছে।

পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেলার ৪ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে নদী ভাঙন তীব্র হয়েছে। এরই মধ্যে ভাঙনে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়াও হুমকিতে রয়েছে মেকলির চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নন্দদুলালের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সারডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চর বিদ্যানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম জানান, ভাঙনে বিলীন হওয়া ৬টি বিদ্যালয়ের প্রতিটির জন্য আপাতত টিনশেড স্কুলঘর নির্মাণে তিন লাখ টাকা করে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। পানি শুকিয়ে গেলে বিদ্যালয়গুলো স্থানান্তরসহ পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের সবকটি নদ-নদীর পানি আরও  বেড়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টা থেকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম। এদিকে একই সময়ে ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা-ধরলা অববাহিকায় দেখা দিয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। ফের প্লাবিত হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের লাখো মানুষ। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় কলার ভেলায় চলাচল করছে লালমনিরহাটের ৬৩ চরের মানুষ।

সর্বশেষ খবর