শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃষক দলে কৃষক নেই

জেলা-উপজেলায় চলছে দেদার পদ-বাণিজ্য, ক্ষুব্ধ বঞ্চিতরা, মাঠে নামার লোক নেই

শফিউল আলম দোলন

পেশায় ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী। থাকেন রাজধানীতে। বছরে দু-একবার গ্রামের বাড়িতে যান। অধীনস্থ নেতা-কর্মীরাই প্রয়োজনে ঢাকায় এসে তার সঙ্গে দেখা করেন। গত বছর ঢাকা থেকে জেলা কৃষক দলের সভাপতির পদটি বাগিয়ে নেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মাযহারুল ইসলাম। একই কমিটির সাধারণ সম্পাদকও একজন আইনজীবী। তবে তিনি জেলায় থাকেন। জেলার ১৩টি উপজেলাসহ পৌরসভা/ইউনিয়ন/ওয়ার্ড কৃষক দলেরও কমিটি দিচ্ছেন তারা। দেদার চলছে পদ-বাণিজ্য। ফলে আন্দোলনের কর্মসূচি দূরের কথা, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মতো অনুষ্ঠানেও কর্মী পাওয়া যায় না। একই চিত্র সারা দেশেই বিদ্যমান। কেন্দ্রের ১৫৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে শতাধিক রয়েছেন ব্যবসায়ী। বাকিদের অনেকে আইনজীবী কিংবা শিক্ষক। হাতে গোনা কজন কৃষিবিদ থাকলেও তাদের বেশির ভাগই এই কমিটি মেনে নিতে না পেরে নিজেরাই দূরে সরে গেছেন।

কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি নিজেও তো ব্যবসা করি। সংগঠনের অনেকেই হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ ছাড়া যারা ছাত্রদল করে পড়াশোনা শেষ করে আসেন, তাদের সবাইকে তো আর একসঙ্গে মূল দলের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় না। তখন বাধ্য হয়েই হয় যুবদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কিংবা এই কৃষক দলে পুনর্বাসন করতে হয়। আর সৎ পথে জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের রাজনীতির বাইরেও কিছু না কিছু করতে হয়। সে কারণে পেশার তারতম্য হতেই পারে। তবে এর মাধ্যমে কৃষক দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না।’ তিন মাসের মধ্যে করার কথা থাকলেও ২০ মাসেও কৃষক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি-এমন প্রশ্নে হাসান জাফির তুহিন বলেন, ছয় মাসের বেশি সময় তো করোনা মহামারীতেই চলে গেল। এর মধ্যে দেশের ৫০টি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বাকি জেলাগুলোতেও শেষ হবে কমিটি গঠনের কাজ। তখন কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আয়োজন করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তরে কৃষক দলের সভাপতি ব্যবসায়ী নাজিমউদ্দিন এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণে অ্যাডভোকেট নাসির হায়দার। তাদের অধীনস্থ ঢাকা মহানগরীর থানাগুলোতেও কৃষক দলের কমিটি রয়েছে। অথচ রাজধানীতে কার্যত কোনো কৃষিজমি নেই, নেই কৃষকও। তবে এখানে কৃষক দলের নেতা-কর্মীর কোনো কমতি নেই। রাজধানীতে কৃষক দলের পদধারী নেতাই আছেন কয়েকশ। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কৃষকসমাজকে সংগঠিত করা এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর বিএনপির সহযোগী সংগঠন কৃষক দলের জন্ম। যেহেতু ইট-পাথরের এই নগরে কৃষক নেই, সেহেতু তাদের সংগঠিত করার সুযোগও নেই। যে কৃষকদের স্বার্থে এই সংগঠন, তার কেন্দ্রীয় কমিটিতে কৃষক বা কৃষক সংগঠক নেই একজনও। এ ছাড়া নেতাদের বেশির ভাগেরই গ্রামে যাতায়াত কম। একজন আহ্বায়ক ও ১২ জন যুগ্ম-আহ্বায়কসহ ১৩৯ জন সদস্য নিয়ে সর্বমোট ১৫৩ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। একই সঙ্গে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার নির্দেশনা থাকলেও ২০ মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি তা গঠন করতে পারেনি। এদিকে জেলা ও উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে কৃষক দলের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর্থিক সুবিধা দিতে না পারায় যারা ত্যাগী ও মামলা-হামলা, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে দীর্ঘদিন ধরে দলের হাল ধরে আছেন, তাদের কাউকেই জেলা-উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন কমিটিগুলোতে বড় কোনো পদে রাখা হচ্ছে না। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা কৃষক দলের কমিটি গঠনের বিষয়টিসহ জেলার বেশির ভাগ থানা কমিটিই এর প্রমাণ। টানা ১২-১৩ বছর ধরে নানা হয়রানি-নির্যাতন সহ্য করে যিনি কৃষক দলের পুরো থানার নেতা-কর্মীদের আগলে রেখেছেন, তার নাম শাহীন আহমেদ। কৃষক দলের জেলা আহ্বায়ক কমিটিতেও সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে তার ও তার বাড়িতে ক্ষমতাসীনদের হামলার ঘটনায় ঢাকা থেকে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী আহমেদ প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেই শাহীন আহমেদকে বাদ দিয়ে নগদ টাকার বিনিময়ে জাতীয় পার্টির এক সক্রিয় কর্মীকে থানা কৃষক দলের সভাপতি বানিয়েছেন অ্যাডভোকেট মাযহারুল ইসলাম। এ ঘটনা সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির অনেক নেতাই অবগত আছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। কৃষক দলের এ চিত্র শুধু এক হোসেনপুর থানাতেই নয়। সারা দেশের প্রতিটি জেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এই পদ-বাণিজ্য। এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির সদস্য সচিব কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো অনিয়মের অভিযোগ আসেনি। এলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর