রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পর্যটনশিল্প

হোটেল মোটেল গেস্ট হাউসে মূল্যছাড়, ভিড় বাড়ছে কক্সবাজার কুয়াকাটা সৈকতে

রুহুল আমিন রাসেল

করোনার এই সময়ে ইদানীং মানসিক প্রশান্তির খোঁজে ঘুরতে বের হওয়া শুরু করেছেন মানুষ। কেউ যাচ্ছেন সমুদ্রে, কেউ যাচ্ছেন পাহাড় কিংবা সমতলের দর্শনীয় স্থানগুলোতে। আর পর্যটক আকর্ষণে হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউসগুলোতেও চলছে মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা। ফলে এসব লুফে নিচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা। পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠা শুরু করেছে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার এবং সাগরকন্যা খ্যাত আরেক সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। এর মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পর্যটনশিল্প। সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, পর্যটনশিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখা পর্যটনশিল্পে করোনার আঘাতে গভীর সংকট দেখা দিলেও, তার ৮০ শতাংশ উত্তরণ ঘটেছে। কারণ পর্যটন নগরী ও সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার পর্যটকদের জন্য খুলেছে গত ১৭ আগস্ট। এর আগেই খুলেছে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। দেশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোতেও পর্যটকদের উপস্থিতি ঘটছে। একই সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আকাশপথে অধিক যাত্রী পরিবহনের আভাসও মিলেছে। এভাবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দেশ-বিদেশে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো পর্যটনশিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে পর্যটন খাতের অভিজ্ঞ বিশ্লেষক ও ভ্রমণবিষয়ক ইংরেজি মাসিক পত্রিকা দ্য মনিটর সম্পাদক কাজী ওয়াহেদুল আলম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারী করোনায় পর্যটনশিল্পে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তার ৮০ শতাংশের উত্তরণ ঘটেছে। এটা অপ্রত্যাশিত উন্নতি। এতদিন যারা বিদেশে যেতেন, তারাও দেশে ঘুরতে বের হয়েছেন। পর্যটন খাতে কিছুটা নতুনত্ব আসছে। হোটেলগুলো ভাড়া কমিয়ে দিচ্ছে। বাসায় আবদ্ধ পরিবেশে থাকা মানুষ এখন প্রশান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এজন্য সপরিবারে ঘুরতে বের হওয়ার হার বাড়ছে। সব মিলিয়ে আবারও গতি ফিরে পাচ্ছে স্থানীয় পর্যটনশিল্প। সূত্র বলছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বেশির ভাগ হোটেলে অতিথির সংখ্যা ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে এলেও, এখন চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। তারকা হোটেল ব্যতীত সারা দেশের হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউসগুলোতে ব্যাপক পর্যটক রয়েছেন। যদিও করোনাকালে বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখের বেশি মানুষ চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছেন। পর্যটনশিল্পে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার তথ্যও দিয়েছে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-টোয়াব। এ প্রসঙ্গে টোয়াব সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, স্থানীয় পর্যটনশিল্প সচল হয়েছে। এই শিল্পের অংশীজনরা কর্মযজ্ঞে ফিরেছেন। কিন্তু ট্যুর অপারেটররা নিষ্ক্রিয়। যতদিন বিদেশিরা না আসবেন এবং বাংলাদেশিরা বিদেশে না যাবেন, ততদিনে পর্যটন খাত পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে না। তার মতে, জনজীবন যখন স্বাভাবিক হবে, স্বস্তি ও শান্তিময় হবে, তখনি মানুষ ঘুরতে বেড়াবেন। কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম বলেন, সত্যিকার অর্থেই এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউসের অধিকাংশ রুম বুকিং রয়েছে। সবাই এখন ব্যবসা ভালো করছেন। এককথায় কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকা পর্যটকদের জমজমাট অবস্থা। আসলে গত ছয় মাসের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মানুষ এখন মানসিক প্রশান্তির জন্য ঘুরতে বের হচ্ছেন। এদিকে পর্যটন খাতের সংকট উত্তরণে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে দেওয়া চিঠিতে টোয়াব বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পর্যটনশিল্প। এই ভাইরাসের কারণে আউটবাউন্ড, ইনবাউন্ড ও অভ্যন্তরীণ পর্যটনের শতভাগ বুকিং বাতিল হয়েছে। এ কারণে শুধু ট্যুর অপারেটররা নয় বরং এ শিল্পসংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জীবিকা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইনস, পর্যটক পরিবহন, ক্রুজিং ও গাইডিং সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী। অন্যদিকে করোনায় বিপর্যয়ের মুখে দেশের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হোটেল খাত বাঁচাতে সরকারের কাছে ছয় দফা সুপারিশনামা দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশন-বিআইএইচএ। সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বলেছে, করোনার প্রভাবে তারকা হোটেল খাতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি চলতি বছরই ৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। এ প্রসঙ্গে বিআইএইচএ সভাপতি এইচ এম হাকিম আলী বলেন, দেশে পর্যটক বাড়ছে। স্থানীয় পর্যটকরা ঘুরতে বের হচ্ছেন। নতুন নতুন রিসোর্টও হচ্ছে। ফলে এক ধরনের চাঙ্গাভাব দেখছি। কিন্তু তারকা হোটেলগুলোর কোনো উন্নতি হয়নি। বিদেশিরা যতদিন না আসতে পারবেন, ততদিন আশা দেখছি না। তবে দেশের যেসব পর্যটক এতদিন বিদেশে ঘুরতেন, তারা এখন স্থানীয় দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে বেরোচ্ছেন। এটা আমাদের পর্যটনশিল্পে ইতিবাচক দিক। তিনি পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বলেন, আগামী তিন বছরের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার সুদমুক্ত ঋণ চাই। করোনা সংকট কেটে গেলে বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের আহ্বান জানাই। হোটেলশিল্পের সংকট উত্তরণে ছয়টি প্রস্তাব দিয়ে বিআইএইচএ বলেছে, হোটেল ও রিসোর্টের বিপরীতে বিদ্যমান ঋণের লভ্যাংশ বা সুদ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ এবং চলমান কিস্তি ২০২১ সালের জুন থেকে চালুকরণ এবং কিস্তি চালুকরণের আগ পর্যন্ত সমস্ত লভ্যাংশ বা সুদ স্থির করা হোক। কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোটেল এবং রিসোর্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের ওপর অর্পিত মোট ৯ শতাংশ সুদ হারের পরিশোধের সময়সীমা ৩ বছর মেয়াদি করা এবং ঋণ বিতরণের তারিখ থেকে এক বছর গ্রেস পিরিয়ড রেখে পরবর্তী ২ (দুই) বছরে পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করা হোক। লকডাউনে ছুটিতে যাওয়া হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫০০ কোটি টাকা বেতন ভিত্তিতে তাদের ব্যাংক হিসাবে প্রদান করা হোক। আবাসিক হোটেলগুলোর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সমস্ত ইউটিলিটি বিল ইলেকট্রিক, ওয়াসা এবং গ্যাস বিল মওকুফ করা হোক। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার আওতাধীন আবাসিক হোটেল এবং রিসোর্টের হোল্ডিং ট্যাক্স ২০২০-২০২১ পর্যন্ত মওকুফ করা হোক। আবাসিক হোটেল এবং রিসোর্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন থেকে কর কর্তন মওকুফ করা হোক।

সর্বশেষ খবর