বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

যত বাধা আমদানি বাণিজ্যে

উৎপাদনে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব, বেড়ে যাবে পণ্যের দাম

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

করোনাভাইরাসের কারণে আরোপিত লকডাউন প্রত্যাহার হলেও গত তিন মাসে স্বাভাবিক হয়নি দেশের আমদানি বাণিজ্য। গত জুনের পর থেকে উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছেন শিল্প-কারখানা পুরোদমে চালু রাখতে। আমদানি বাণিজ্যে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। উপরন্তু শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ দেশের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য সময়মতো আমদানি করতে না পারায় শুধু যে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাই নয়, এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন উৎপাদন খাতের সঙ্গে উদ্যোক্তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করতে গিয়ে তারা নানা ধরনের বাধার মুখে পড়ছেন। ডলার সংকট, ব্যাংকগুলোর এলসি খুলতে অনীহা, কাস্টমসে পণ্য ছাড়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এখন নিত্যনৈমত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানিকারকরা বলছেন, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পণ্যের উৎপাদন ও মূল্য পরিস্থিতিতে। আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুনের পর থেকে শিল্প-কারখানা চালু হলেও ওই সময় ডলার সংকটের কথা বলে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে চায়নি। কোনো কোনো ব্যাংক এলসি খুলতে চাইলেও বিদেশি সাপ্লায়াররা তা গ্রহণ করেনি সময়মতো এলসির দেনা পরিশোধ না করার কারণে। এখন ডলার সংকট কিছুটা কাটলেও আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখনো সংরক্ষণমূলক মনোভাব ধরে রেখেছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সময়মতো এলসি জটিলতা সমাধান না হলে প্রয়োজনের সময় শিল্পের কাঁচামাল আনা সম্ভব হবে না। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে। বেড়ে যাবে নিত্যপণ্যের দাম। এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে লকডাউনের সময় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সমস্যা হয়েছিল, এখন তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। ব্যাংকগুলোও এলসি খুলছে। তবে নতুন বাজেট ঘোষণার পর কাস্টমসে পণ্য ছাড়ের ক্ষেত্রে এখনো কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে জানান এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, কোনো কোনো পণ্যের ওপর দীর্ঘদিন ধরে যে ডিউটি আরোপিত ছিল সেটি হঠাৎ করে বাড়ানো হয়েছে। ফলে কাস্টমস অ্যাসেসম্যান্টে গিয়ে পণ্যটি আটকে যাচ্ছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে এফবিসিসিআই সুনিদ্দির্ষ্ট পণ্য ধরে ধরে সমাধানে কাজ করছে বলে জানান তিনি। উদ্যোক্তারা বলছেন, লকডাউন তুলে নেওয়ার পর গত জুন থেকে ব্যাংক-বীমায় শিফট করে কাজ করলেও সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে অফিস-আদালতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু এরপরও অনেক দফতরে চলছে ঢিলেঢালা অবস্থা। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট বা আমদানির কাগজপত্র তুলতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে সঠিক সময় দায়-দেনা পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। আমদানিকারকের অভিযোগ নানা ধরনের বাধা পেরিয়ে পণ্য আনার পরও বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় বন্দরে। জানা গেছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এখনো আকাশপথে যোগাযোগ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হওয়ার কারণেও আমদানি বাণিজ্যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদার কারণে দ্রুত পণ্য সরবরাহ করতে অনেক সময় জাহাজের পরিবর্তে এয়ার কার্গোতে কাঁচামালসহ নানা পণ্য আমদানি করতে বাধ্য হন শিল্পোদ্যোক্তারা। দেখা গেছে, এয়ার কার্গোগুলো এখন পণ্য আনতে দ্বিগুণ ভাড়া চাচ্ছে। আবার পণ্য আনার পর সেগুলো এয়ারপোর্ট থেকে ছাড়েও দেখা গেছে নানা জটিলতা। ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে পণ্য আনতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন এক নারী উদ্যোক্তা। বিষয়টি তিনি ফ্রান্সের সাপ্লায়ারকে জানানোর পর ওই সাপ্লায়ার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘...পর পর তিনটা শিপমেন্ট প্রোডাক্ট বাংলাদেশে এয়ারপোর্টে আটকা পরে আছে শুধু কাস্টমসের গাফিলতির কারণে। চার নম্বর শিপমেন্টের সময় এখানকার (ফ্রান্সের) কার্গো হেড অফিস জানিয়ে দিল, তারা আর পণ্য নেবে না, দেশেও পাঠাবে না। কত বড় জ্বালায় যে আছি।’ অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারার্স কোম্পানি ডোরাসকে লিমিটেডের এমডি ওবায়দুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, শিল্প চালাতে তাদের কাঁচামাল ছাড়াও প্রতিনিয়ত কেমিক্যালসহ দাহ্য পদার্থ আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রথম দফায় ঝামেলায় পড়েন তারা ব্যাংকে এলসি খুলতে গিয়ে, এরপর নানা বিঘ্ন পেরিয়ে আমদানিকৃত পণ্য যখন চট্টগ্রাম বন্দরে আসে তখন শুরু হয় আরেক দফা ঝামেলা। ওবায়দুর রহমান বলেন, আমদানিপণ্যের শিপিং, হ্যান্ডলিং থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই দীর্ঘসূত্রতা চলে চট্টগ্রাম বন্দরে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় বন্দরে যেখানে পণ্য ছাড়ে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে সেখানে বাংলাদেশে ৩ থেকে ৪ দিনের আগে কল্পনাই করা যায় না। আমদানি পণ্য ছাড়ে এ ধরনের বিলম্বের কারণে কনটেইনার আটকে থাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কনটেইনার দিতে অনীহা দেখাচ্ছে বলেও জানান এ উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বাণিজ্য সংক্রান্ত সেবাগুলো একই ছাতার নিচে নিয়ে আসার বিষয়ে তারা সরকারের সঙ্গে অনেকবার আলোচনা করেছেন। তবে সরকারি দফতরগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর