রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

কমছে পানি ভাঙছে পাড়

নদীগর্ভে গ্রামের পর গ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

কমছে পানি ভাঙছে পাড়

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এক দিনের ব্যবধানে গতকাল বিপৎসীমার নিচে নেমেছে ছোট যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি। এতে নওগাঁ ও কুড়িগ্রামের কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও অন্যান্য নদীর পানি বাড়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে নতুন নতুন এলাকায়। গতকালও সাতটি নদীর পানি ১১টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত রয়েছে গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, রাজবাড়ীসহ দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বেশ কিছু জেলা। নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় নদী ভাঙন তীব্র হয়েছে অনেক এলাকায়। কুষ্টিয়ায় ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রায়টা-মহিষকুন্ডি নদী রক্ষা বাঁধ। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল সকালের তথ্যানুযায়ী, ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি চক রহিমপুর পয়েন্টে ১১৩ সেন্টিমিটার, যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ৩৪  সেন্টিমিটার, কাজিপুর পয়েন্টে ২১ সেন্টিমিটার ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার, গুড় নদীর পানি সিংড়া পয়েন্টে ৩৮  সেন্টিমিটার, আত্রাই নদীর পানি বাঘাবাড়ী পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার ও আত্রাই পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরীর পানি এলাসিন পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার এবং পদ্মার পানি গোয়ালন্দে ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমছে ও যমুনার পানি স্থিতিশীল আছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উভয় নদীর পানি কমতে পারে। গঙ্গার পানি স্থিতিশীল আছে, বাড়ছে পদ্মার পানি যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে। আজকের মধ্যে দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্যাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

দিনাজপুর : জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। করতোয়ার পানিতে উপজেলার দাউদপুর, বিনোদনগর, কুশদহ ও মাহমুদপুর ইউপির বিভিন্ন গ্রামের বসতবাড়ি ও ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভাঙন। নদী ভাঙনে বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে ভোটারপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম, মুনছুর আলী, ইয়াকুব আলীসহ অনেক পরিবারকে। বিনোদনগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনোয়ার হোসেন জানান, করতোয়া নদীর ভাঙনে হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের ফসলি জমি। ভাঙনের কবলে রয়েছে করতোয়া নদীঘেঁষা বিনোদনগর ইউপির ভোটারপাড়া, কাঁচদহ, উ. কাঁচদহ, উ. মাঝিপাড়া ও দ. মাঝিপাড়ার কৃষিজমি, ঘরবাড়ি, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দিরসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার রয়েছে হুমকিতে। তিনি বলেন, নদীটি অনেক সরে এসেছে। পূর্বের প্রবাহে ফিরিয়ে নিতে পারলে ভাঙন রোধ হতো। এজন্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার নদী খনন করতে হবে।

কুড়িগ্রাম : নদ-নদীর পানি কমে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। তবে নদী ভাঙনের তীব্রতায় দিশাহারা মানুষ। নদ-নদীর পানি কমলেও বন্যাকবলিত নিম্নাঞ্চল ও চরের মানুষজনের এখনো দুর্ভোগ রয়েছে। বাড়িঘর, হাঁস-মুরগি, গাছপালা নদীতে ভেসে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য সংকটে রয়েছেন তারা। ৫ম দফা বন্যায় ১৮ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমনসহ ফসল ডুবে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে কৃষক।

জেলার বিভিন্ন উপজেলার ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের ৬৩টি পয়েন্টে প্রচ- নদী ভাঙন চলছে। উলিপুরের থেতরাই এলাকার কাশেম বাজার ও সদর উপজেলার ভোগডাঙায় প্রতিদিন নদী ভাঙনে বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দিরসহ ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। দুধকুমার নদীর ভাঙন রোধে প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল দুপুরে মানববন্ধনের আয়োজন করে ‘ভূরুঙ্গামারী উন্নয়ন সংস্থা’। ভূরুঙ্গামারী-সোনাহাট স্থলবন্দর মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে উপজেলার সামাজিক সংগঠন, ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন পেশার সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেন।

কুষ্টিয়া : দৌলতপুরে পদ্মার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। গত ১০ দিনে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নে বেশ কিছু ঘরবাড়িসহ বিস্তীর্ণ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রায়টা-মহিষকুন্ডি নদী রক্ষাবাঁধ। নদী থেকে মাত্র ৫০০ ফুট দূরে রয়েছে ভারত থেকে আসা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে অচিরেই এসব স্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে মরিচা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম। ইউনিয়নের ভুরকা-হাটখোলা থেকে কোলদিয়ার পর্যন্ত  প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিনে শত বিঘা জমি নদীর পেটে চলে গেছে। প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে ৪ ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, বাগানসহ অনেক স্থাপনা। নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ।

বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা ও বাঙ্গালি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উভয় নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ডুবে গেছে ফসলের খেত। লোকালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ফসল বাঁচাতে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খামারকান্দি ইউনিয়নের ঘোরদৌড় গ্রামে ডুবে যাওয়া জমিতে শ্যালো মেশিন বসিয়ে পানি নিষ্কাশনের প্রাণপণ চেষ্টা করছেন কয়েকজন কৃষক। এই গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মো. গোলাম রব্বানী জানান, তিনি আট বিঘা জমিতে ধান ও দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছেন। ফসল ঘরে তুলতে প্রায় দেড় মাস বাকি। এরই মধ্যে বৃষ্টি ও উজানের পানিতে ডুবে গেছে তার সব ফসল। ওই গ্রামসহ আশপাশের অন্তত দশটি গ্রামের ফসলি মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। ফসল বাঁচাতে গ্রামের আরও কয়েকজন কৃষককে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় মেঘাই খালের মুখ বন্ধ করে শ্যালো মেশিন বসিয়ে দিনরাত পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে ৪ ফুট পানি কমাতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মতো আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা মেঘাই খালের মুখে স্লুইস গেট তৈরির দাবি জানিয়েছেন।

নওগাঁ : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়ে রানীনগর, আত্রাই ও মান্দা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। রানীনগর, আত্রাই ও মান্দা উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৭টি স্থানের ভাঙা অংশ মেরামত না করায় হু হু করে পানি ঢুকছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে কাঁচা ঘরবাড়ি। তলিয়ে যাচ্ছে ফসলের মাঠ। উঁচু স্থান ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। জেলায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।

সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। নতুন করে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে তাঁত কারখানা। নষ্ট হচ্ছে তাঁতের সরঞ্জামাদি। বেকার জীবন-যাপন করছে লক্ষাধিক তাঁত মালিক-শ্রমিক। পানিতে ডুবে থাকায় নষ্ট হচ্ছে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র। রান্নাঘর ডুবে থাকায় জ্বলছে না চুলা। অনেক পরিবার ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাকবলিতদের মধ্যে দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সংকট।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর