সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

তিন মাস ধরে পানির নিচে ৪০ গ্রাম

প্রকট হচ্ছে ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যা, মরদেহ দাহ করার জায়গা নেই, পেট কেটে কলসি বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিলে

সাইফুল ইসলাম, যশোর

তিন মাস ধরে পানির নিচে ৪০ গ্রাম

ভবদহ এলাকার মশিহাটি গ্রাম। বাড়ি ঢুকতে ও এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতেও ব্যবহার করতে হচ্ছে বাঁশের সাঁকো -বাংলাদেশ প্রতিদিন

যশোরের ভবদহ এলাকার তিনটি উপজেলার ৪০টি গ্রাম তিন মাস ধরে পানির নিচে তলিয়ে আছে। উঠানে, বারান্দায় পানি। টয়লেট, গোয়ালঘরেও হাঁটুপানি। ডুবে আছে ফসলের খেত। কাজ নেই, রুটি-রোজগারের সব পথ বন্ধ। 

ঠিক এক মাস আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, জোয়ারের সঙ্গে যে পরিমাণ পানি ঢুকছে, ভাটায় সে পরিমাণ পানি নামছে না। সে কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জোয়ারভাটা স্বাভাবিক গতিতে ফিরলে কয়েকদিনের মধ্যেই পানি নেমে যাবে। একমাস পর গতকাল সারা দিন ভবদহ এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতা সমস্যার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, বরং বেশির ভাগ এলাকায় পানি অনেক বেড়েছে। মণিরামপুরের ডহর মশিহাটি গ্রামের সুজিত বিশ্বাসের উঠানে কোমর পানি। বাড়িতে ৫ জন মানুষ, তিনটি গরু। কৃষিকাজ করেই সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, ৫ বিঘা কৃষিজমির পুরোটাই পানির নিচে। গত দুই বছর ফসল ফলাতে পারিনি। মাছ ধরে কোনোমতে আধপেট খাবারের সংস্থান করছি। প্রতিমা বিশ্বাসের বাড়িতেও একই অবস্থা। পানির নিচে টিউবওয়েল, টয়লেটও। জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের বেশির ভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী। সুন্দলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীনেশ বিশ্বাস বলেন, কেউ মারা গেলে মরদেহ দাহ করার জায়গা নেই। তিন-চারটি শ্মশানের সবকটিই পানির নিচে। গত দুই-তিন মাসে যারা মারা গেছেন, তাদের পেট চিরে কলসি বেঁধে বিলের পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। মশিহাটির বিশ্বজিৎ মন্ডল বলেন, কিছুদিন আগে একই গ্রামের প্রদীপ মন্ডলের মা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। দাহ করার জায়গা না পেয়ে তার মরদেহও কলসি বেঁধে বিলের পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ভবানীপুর গ্রামের দেবেন্দ্র লাল  মল্লিক বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড বারবার নদী খনন করে। কিন্তু খননের ২-৩ দিন পরই আবার তা ভরাট হয়ে যায়। এভাবে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না জেনেও অজ্ঞাত কারণে তারা নদী খনন করতেই বেশি আগ্রহী। তিনি বলেন, ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পরীক্ষিত উপায় রয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সেদিকে আগ্রহী নয়। অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কফিল বলেন, ভবদহ এলাকার অর্ধেক অংশের পানি অভয়নগরের আমডাঙ্গা খালের মাধ্যমে ভৈরব নদে গিয়ে পড়ে। এই আমডাঙ্গা খাল আরও গভীর ও প্রশস্ত করে সংস্কার করলে ভবদহ এলাকার অর্ধেক অংশের পানি দ্রুত নেমে যেতে পারবে এবং সামনে কার্তিক মাসেই কৃষকরা ফসল ফলাতে পারবেন। ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসন কমিটির সভাপতি এনামুল হক বাবুল বলেন, নদী এবং বিল নিয়ে যে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বা জোয়ারাধার প্রকল্প, জলাবদ্ধতা নিরসনে তা খুবই ভালো ফল দিয়েছিল। মাত্র একটি বিলে টিআরএম করায় ৫ বছর এলাকার মানুষ ভালোভাবে ফসল ফলাতে পেরেছিল। কিন্তু পরে আর এই প্রকল্প চালু করা হয়নি। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে পরীক্ষিত এই টিআরএম প্রকল্প আবার চালু করা হলে এবং আমডাঙ্গা খাল গভীর ও প্রশস্ত করা হলে আগামী ৫০-৬০ বছর এ এলাকায় জলাবদ্ধতা সমস্যা দেখা দেবে না। এনামুল হক বাবুল বলেন, টিআরএম অব্যাহত রাখতে টিআরএমের দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি প্রকল্পও প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই কমিটির সভায় টিআরএম কার্যক্রমকে বাদ দিয়ে ৮০৭ কোটি টাকার একটি সংশোধিত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। টিআরএমের বিকল্প হিসেবে প্রতি বছর নদীর পাইলট চ্যানেল খনন করে কোনো সমাধান হচ্ছে না। এ এলাকার নদ-নদীগুলোর নাব্যতা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে এবং জলাবদ্ধতার সমস্যা ভবদহ এলাকা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী তেলিগাতি, গ্যাংরাইল অববাহিকায়ও বিস্তৃত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর