শিরোনাম
সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে রিয়াজুল করিম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রিমিয়ার ব্যাংক

কৃষি খাত আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে

আলী রিয়াজ

কৃষি খাত আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে

রিয়াজুল করিম

প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রিয়াজুল করিম বলেছেন, করোনা সংকটে আমাদের অর্থনীতি বাঁচিয়ে দিয়েছে কৃষি খাত। দেশের আর্থিক কর্মকান্ডে সব খাতই ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি খাত তুলনামূলক কম প্রভাবিত হওয়ায় অর্থনীতি টিকে আছে।  বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, রেমিট্যান্সের চেয়েও অর্থনীতিতে এখন বেশি ভূমিকা কৃষি খাতের। কৃষি খাত না থাকলে প্রবৃদ্ধির কোনো সূচকই আমরা ধরে রাখতে পারতাম না। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সামনে ব্যাংকিং খাতের চিন্তার বিষয় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া এবং শিল্পোন্নয়নের ধারা ব্যাহত হওয়া। যা অর্থনীতিতে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল রেখেছে, যা অর্থনীতির জন্য আশার আলো। আমরা চেষ্টা করছি নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ করতে। উদ্যোক্তাদের পাশে আমরা নিজেরাই যাচ্ছি। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত করোনাকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ  বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রিমিয়ার ব্যাংক  দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। আমরা আশা করছি, অচিরেই করোনাকালীন এ দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম  হব। প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রিয়াজুল করিম ৩৬ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে একজন দক্ষ ব্যাংকার বিভিন্ন ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে  যোগ দিয়ে ২০১৮ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। চলতি করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতি বিশেষ দায়িত্বশীল এই ব্যাংকার প্রণোদনা বাস্তবায়ন, ঋণ বিতরণ, আদায় ও আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাংককে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নিয়ে এসেছেন। রিয়াজুল করিম বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত করোনার আগেই বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে ৬ এবং ৯ শতাংশ সুদের কারণে। এই কঠিন ধাক্কার সঙ্গে  যোগ হয়েছে করোনা। এই দুই মিলে ব্যাংকিং খাত একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে ২০২০ সালে। প্রিমিয়ার ব্যাংক বিশ্বাস করে সবার আগে দেশ ও  দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারলে ব্যাংক বাঁচবে এবং এদেশের মানুষ বাঁচবে। তাই বর্তমানে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি কাস্টমারদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। কারণ তাদের সহযোগিতা করে তাদের ব্যবসা সচল করতে পারলে দেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। সেইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতও ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে চাইলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধান করতে হবে। সেই সঙ্গে দারিদ্র্য দূর করতে হবে। যদি তাই করতে হয়, তাহলে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সিএমএসএমই এবং কৃষি খাতকে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ যুক্ত আছে এই খাতের সঙ্গে। তাই প্রিমিয়ার ব্যাংক দেশকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে সিএমএসএমই ও এগ্রিকালচারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। করোনাকালীন কৃষি খাতের যে অভূতপূর্ব ভূমিকা পুরো দেশকে বাঁচিয়েছে। যারা পণ্য উৎপাদন করে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে সেটা দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা যাবে না। কৃষি উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিনির্ভর নয় কিংবা আমদানি করেও ফসল ফলাতে হয় না। সংকট শুরু হওয়ার পরেই দেখা গেল কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না শিল্প কারখানার অনেক মালিক। কিন্তু কোনো কৃষক বলেনি যে টাকার অভাবে কৃষি করতে পারছি না। সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে তার বড় সুবিধাভোগী শিল্প মালিকরা। কৃষকরাও পেয়েছে। তবে তাদের পাশে আমাদের আরও ভালোভাবে দাঁড়ানো দরকার। বিশিষ্ট এই ব্যাংকার বলেন, সিএমএসএমই এবং এগ্রিকালচার খাতে প্রণোদনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করে কাস্টমারদের সহযোগিতা করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমরা প্রণোদনা টার্গেটের প্রায় অধিকাংশই প্রসেস করে ফেলেছি। আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ দেওয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা সম্পূর্ণ টার্গেট অর্জন করতে পারব। প্রণোদনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। আমরা যেসব কাস্টমারকে প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা সমৃদ্ধির জন্য যে টাকা দিয়েছি, তারা যদি সেই টাকা সঠিকভাবে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত প্রদান করেন, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর লাভবান হবে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যাংকিং খাত চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব খুব বেশি। শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করেন। একটি সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের অনীহা। এটা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই করপোরেট কালচার না থাকলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান দেশের প্রতি দায়বদ্ধ হিসেবে পরিচালিত হয়। একজন ব্যক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুললেও প্রতিষ্ঠানটি একক ব্যক্তির নয়। স্বচ্চতা, জবাবদিহিতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই নিশ্চিত করতে হবে। শুধু করপোরেট কালচার না থাকায় আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রিয়াজুল করিম বলেন, করোনার কারণে আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে নানা পরিবর্তন এনেছি। মোবাইল অ্যাপস শক্তিশালী করেছি, ডিজিটাল লেনদেনে পরিবর্তন এনেছি, ক্ষতিগ্রস্ত কাস্টমার যারা করোনাকালে কিস্তি দিতে পারেনি তাদের আমরা সর্বোচ্চ ৯ মাসের কিস্তি মুলতবি এবং লোনের মেয়াদ সর্বোচ্চ নয় মাস বাড়িয়ে দিয়েছি। বিগত বছরগুলোর মতো প্রিমিয়ার ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি দৃশ্যমান। বর্তমান করোনা মোকাবিলা করে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১,৮৪৬.১৭ কোটি টাকা। ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯,১৮১.৪০ কোটি টাকা। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বরে আমানত ও ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২০,৯৩৪.৬০ কোটি টাকা এবং ১৮,৮৯৪.৫৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের আমানতের লক্ষ্যমাত্রা ২৩,২০০.০০ কোটি টাকা এবং ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ২০,১০০.০০ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী। তিনি বলেন, এই সংকটের মধ্যে অনেক ব্যাংক কর্মী ছাঁটাই করেছে। কিন্তু আমরা বিপরীত পথে হেঁটেছি। অর্থাৎ নতুন ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার (এমটিও), ট্রেইনি জুনিয়র অফিসার (সাধারণ) পদসহ অভিজ্ঞ পদে বিপুল সংখ্যক জনবল নিয়োগ দিচ্ছি। এ ছাড়াও, এখন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানে লোকবল কমানো কিংবা কর্মকর্তাদের বেতন কমানো হয়নি বরং নিয়মমাফিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পরিচালনা পর্ষদের সম্মানিত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এইচ বি এম ইকবালের সুদক্ষ নেতৃত্বে এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতায় আমরা আমাদের করণীয় ঠিক করে অগ্রসর হচ্ছি। করোনা সৃষ্ট মন্দা কাটাতে এবং রাষ্ট্রীয় ঋণ প্রণোদনাসহ অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতিতে কার্যকর অবদান রাখতে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।

সর্বশেষ খবর