মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

সমস্যায় বাংলাদেশের অহংকার জামদানি

মোস্তফা মতিহার

সমস্যায় বাংলাদেশের অহংকার জামদানি

আটপৌরে শাড়িতেই ফুটে উঠে বাঙালি নারীর রূপের মোহনীয়তা। এই শাড়ির সঙ্গে শুধু নারীর সৌন্দর্যই নয়, মিশে আছে এ দেশের ঐতিহ্যও। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের বয়নশিল্প নিয়ে অনেকের আগ্রহ থাকলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে গৌরবের স্থান দখল করেছে ঢাকাই জামদানি। সুতায় বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁতীর পরিশ্রম ও ঘামে এ দেশের নারীদের হৃদয় হরণ করেছে জামদানি। তাঁতীদের ঘামে-শ্রমে ও বয়নের অতুলনীয় পদ্ধতিতে ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্য সাধারণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিবল কালচারাল হ্যারিটেইজ) স্বীকৃতি অর্জন করার পর জামদানির মাধ্যমে বিশ্বে নতুন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। তাঁতের সঙ্গে শিল্পীর সুনিপুণ কারুকাজে জামদানি আজ শুধু বাংলাদেশেরই নয়, গোটা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য শিল্প। তবে এর আগেই ভারতের বিখ্যাত নির্মাতা সঞ্জয়লীলা বানসালি পরিচালিত শরৎচন্দ্রের মেগাহিট চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’-এ পার্বতীরূপী ঐশ্বরিয়া জামদানি পরিধানের পর দেশের জামদানির সমৃদ্ধি ও সুনামের পথে এক ধাপ এগিয়ে যায়। আর সর্বশেষ ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে বিশ্বে এখন জামদানির জয়জয়কার। নান্দনিক নকশা, বাহারি রং আর সূক্ষ্ম বুননে জামদানির রয়েছে ভিন্নতা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে প্রতিটি শাড়িই যেন সেরা। সৌন্দর্য, সুষমা আর বৈচিত্র্যময় ডিজাইনে একটি থেকে অন্যটি সম্পূর্ণ আলাদা। আভিজাত্য, ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকেও অন্য কিছুর সঙ্গে এ দেশের জামদানির তুলনা চলে না।

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাবতে গড়ে উঠেছে জামদানি পল্লী। বিসিক শিল্পনগরীর এই অঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ২০০ তাঁতে বুননে ও শিল্পে কাজ করছেন প্রায় আড়াই হাজার জামদানি শিল্পী। তেরছা, জলপাড়, পান্নাহাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলাফুল, আঙ্গুরলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুটিদার, ঝালর, ময়ূরপাখা, পুঁইলতা, ময়ূরপ্যাঁচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, প্রজাপতি, জুঁইবুটি, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল ইত্যাদি নামে নান্দনিক ডিজাইনের জামদানি রয়েছে তারাবর এই জামদানি পল্লীতে। সুতায় বাহারি রঙের ব্যবহার ও ডিজাইনে ভিন্নতা এনে এই অঞ্চলের তাঁতীরাই এ দেশের ঐতিহ্যের এক বিরাট অংশ হয়ে আছেন।

সুতা ও ডিজাইন ভেদে সর্বনিম্ন আড়াই হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকার মধ্যে জামদানি পাওয়া যায় বলে জানালেন তারাব বিসিক শিল্পনগরীর জামদানি ব্যবসায়ী সাজিদ উইভিং ফ্যাক্টরির কর্ণধার মোহাম্মদ শাহ আলম। তিনি জানান, সাড়ে ৩০০ ফ্যাক্টরির কোনোটিতে একটি, কোনোটিতে দুটি আর কোনোটিতে তিনটি তাঁত রয়েছে। এতে প্রায় আড়াই হাজারের ওপর তাঁতী কাজ করছেন। তবে করোনাকালে সবকিছু বন্ধ থাকায় জীবিকার তাগিদে অনেক তাঁতী পূর্ব পুরুষদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তিনি জানান, ডিজাইন ভেদে প্রতিটি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ১ সপ্তাহ থেকে প্রায় তিন মাস পর্যন্ত। কারিগররাই ডিজাইন করে থাকে, তবে কেউ যদি নিজস্ব ডিজাইন দেয় তাতেও কাজ করে দেয় তাঁতীরা। মসলিন বয়নে যেমন ন্যূনপক্ষে ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়, জামদানি বয়নে সাধারণত ৭০-৮০ কাউন্টের সুতা ব্যবহৃত হয় বলেও জানালেন তিনি। এক সপ্তাহের মধ্যে নির্মিত প্রতিটি শাড়ির দাম রাখা হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, আর ৪ দিনের মধ্যে তৈরি করে দেওয়া শাড়ির দাম রাখা হয় আড়াই হাজার টাকার মতো। তবে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা দামের শাড়িগুলো তৈরি করা হয় অর্ডারের ভিত্তিতে। প্রতি শুক্রবার এখানে জামদানির হাট বসে। ভোর ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির এই হাটে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে জামদানিপ্রেমীরা। পাইকারি ও খুচরা সব ধরনের জামদানিই বিক্রি হয়ে থাকে এই হাটে। মোহাম্মদ শাহ আলম আরও বলেন, রং, ডায়িং ও তাঁতীদের মজুরি সব কিছু মিলে জামদানির ব্যবসা এখন আর আগের মতো নেই। ব্যাংক লোনের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণ দিলেও চড়া সুদের কারণে ঋণের প্রতি জামদানি ব্যবসায়ীদের কোনো আগ্রহ নেই। এ ছাড়া বিসিক-এর লোকজনের সঙ্গে লিয়াজোঁ না করলে ঋণ পাওয়াটাও কষ্টকর। তারাব, নয়াপাড়া, রূপসী এলাকাগুলো জামদানির জন্য প্রসিদ্ধ হলেও জামদানি পল্লীর রাস্তার দূরবস্থার কারণে কোনো বিদেশি এবং কোনো বিখ্যাতরা এখন আর এই অঞ্চলে আসতে চায় না। যার কারণে আমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। জামদানি পল্লীকে ঘিরে বিসিক তাদের কার্যক্রম চালালেও পল্লীর রাস্তা সংস্কার ও মেরামতে বিসিকের কোনো মাথাব্যথা নেই।

রাহিম জামদানির কর্ণধার ও জামদানি শিল্পী আলমগীর হোসেন বলেন, জামদানি শাড়ি ইউনেস্কোর কালচারাল হ্যারিটেজের স্বীকৃতি অর্জন করার পরও এর পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের কোনো উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করছি না। জামদানির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো তাঁতে বোনা হস্তশিল্পের কাজ। তাঁতে হাতের কাজ ছাড়া জামদানি তৈরি করা যায় না। কিন্তু ইদানীং ভারত থেকে মেশিনে তৈরি জামদানি শাড়ি এ দেশে আমদানি করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, অন্যদিকে আসল জামদানির সুনামও ক্ষুণœ হচ্ছে। আমরা ঋণ চাই না। আমরা চাই মেশিনে তৈরি ভারতের জামদানিগুলো এ দেশে আসা বন্ধ হোক আর আমাদের ঘামে ও শ্রমে তৈরি জামদানিগুলো বিদেশে রপ্তানি হোক। আমাদের তথা জামদানির পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার যদি এগিয়ে আসে তাহলে এই শিল্প দিন দিন সমৃদ্ধির পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

জামদানি পল্লী পরিদর্শনকালে কথা হয় বেশ কয়েকজন তাঁতীর সঙ্গে। তাঁতী আকাশ জানান, প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ধানতেছি নামক একটি ডিজাইনের শাড়ি বুননকালে তিনি বলেন, বিক্রির অর্ধেক পাবে মালিক আরেক অর্ধেক আমি। এই পেশার মাধ্যমে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করা যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৪ ভাই ও এক বোনের সংসারের তিন ভাই-ই জামদানির তাঁতী। ৩ ভাই কাজ করছি বলে সংসার চালাতে পারছি, না হলে চলতে পারতাম না। তার কথার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাঁতী সাইফুল বললেন, তাঁতীদের উন্নয়নে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের ঘামে ও শ্রমে এই শিল্প আজ ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করলেও আমাদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। চারপুরুষ ধরে আমরা অবহেলিত। তাঁত বোর্ড থেকে লোন দিলেও সিন্ডিকেটের কারণে আমরা তা পাই না। বিসিকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে তাঁতীরা কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে। আক্ষেপ করে সাইফুল বলেন, আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এ পেশায় আসুক।

ইতিহাস মতে, প্রাচীনকালে মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের কাছে অনেক বেশি সমাদৃত। মসলিনের ওপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হতো। জামদানি বলতে সাধারণত? শাড়িকে বোঝালেও জামদানি দিয়ে একসময় নকশি ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হতো। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এ ছাড়া মুঘল ও নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হতো।

জামদানির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে। এক মতানুসারে ‘জামদানি’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি জামা অর্থ কাপড় এবং দানা অর্থ বুটি, সে অর্থে জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়। এ কারণে মনে করা হয় মুসলমানরাই ভারত উপমহাদেশে জামদানির প্রচলন ও বিস্তার করেন। ইউরোপীয়, ইরানি, আর্মেনিয়ান, মুঘল, পাঠান প্রভৃতি বণিকরা মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানরাও জামদানি শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন।

আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ বইতে এবং বিভিন্ন আরব, চীন ও ইতালির পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনায় জামদানির উল্লেখ পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মানের ‘স্রিল সিলাই-উত-তওয়ারিখে’ বইয়ে রুমি নামের রাজ্যে সূক্ষ্ম সুতি কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার বর্ণনানুসারে, রুমি রাজ্যটি হচ্ছে বর্তমানের বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষে সোনারগাঁ এলাকাস্থিত সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। ঐতিহাসিক টেলরের বর্ণনা মতে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। তার মতে, ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা। ১৭৪৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলার নবাব ও জগৎশেঠের জন্য দিল্লির বাদশাহ প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার জামদানি কেনেন।

সর্বশেষ খবর