বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

কর্মসংস্থানে দীর্ঘমেয়াদি সংকট

সংকুচিত হয়ে আসছে বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ । প্রবাসীরা ফেরত আসছেন প্রতিনিয়ত দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা

মানিক মুনতাসির

কর্মসংস্থানে দীর্ঘমেয়াদি সংকট

মহামারী কভিড-১৯-এর আতঙ্ক কমলেও দেশ-বিদেশের কর্মবাজারের আতঙ্ক বেড়েছে কয়েক গুণ। টানা ছয় মাসের বেশি কভিড-১৯-কে সঙ্গী করেই জীবন-জীবিকার জন্য যুদ্ধ করছে মানুষ। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বহু শিল্পকারখানা। মানুষের ভোগবিলাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই শিল্পের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন শিল্পমালিকরা। কেননা বাজারে আগের মতো আর চাহিদা নেই। একমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যসব বেচাকেনা ঠেকেছে তলানিতে। ফলে লোকসানের মুখে পড়েছেন অনেক শিল্পমালিকও। আর কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে হতাশা।

কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় থাকলেও চাকরি হারানোর আতঙ্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। আবার সারা দেশের অধিকাংশ জেলা বন্যাকবলিত হওয়ায় নিত্যপণ্যের বাজারেও চলছে দর বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। যার প্রভাব পড়ছে ক্রেতাসাধারণের ওপর। পাশাপাশি সংকুচিত হয়ে আসছে বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগও। প্রবাসীরাও ফেরত আসছেন প্রতিনিয়ত। পূর্বে দেশে আসা প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্রে ফিরতে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। ফলে দেশের সংকুচিত হয়ে আসা কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সংকট। এ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। যদিও মন্দা পরিস্থিতির উত্তরণে সরকার ১ লাখ কোটি টাকার বেশি কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, করোনায় বাংলাদেশের প্রতি চারজনে একজন বেকারত্বের শিকার হচ্ছেন। একইভাবে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসির হিসাবেও নতুন করে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন করোনা আঘাতে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা, ব্যাংক-বীমা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগও চ্যালেঞ্জের মুখে। ফলে নতুন চাকরির সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে চাকরিচ্যুতি করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এতে বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সব ক্ষেত্রে। শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত দুই শ্রেণির চাকরিজীবীরাই বাধ্য হচ্ছেন ঢাকা ছাড়তে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছেন, সে পরিমাণ কর্মক্ষেত্র নেই। ফলে উচ্চশিক্ষিতের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে এসএসসি পাস বা এর নিচে থাকা জনগোষ্ঠী শ্রমিক হিসেবে বা কারিগরি বিভিন্ন খাতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কভিড-১৯-পরবর্তী দুনিয়া কেমন হবে তা হয়তো এখনই বলা যাবে না। তবে এটা বলা যায়, কভিড-১৯-এর কারণে কর্মবাজারে যে প্রভাব পড়েছে এর রেশ টানতে হবে বহুদিন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ একটু বেশিই। কেননা আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে সম্পদের পরিমাণ খুব কম। ফলে কাজের সুযোগই সীমিত। পাশাপাশি যারা দেশের বাইরে কর্মরত ছিলেন তাদের অনেকেই ফিরে এসেছেন এটাও একটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। কেস স্টাডি-১ : একটি বেসরকারি কোম্পানির হিসাব বিভাগে চাকরি করতেন তারেক হাসান। গত এপ্রিল-মেতে টানা সাধারণ ছুটির সময় কোম্পানি শখানেক কর্মীকে ছাঁটাই করলে তিনিও এর শিকার হন। জীবিকার তাগিদে এখন ব্যক্তিগত গাড়িচালকের চাকরি নিয়েছেন। গতকাল এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় এক প্রকার কেঁদেই ফেলেন তারেক। জানান, শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে তিনি এখন কাজ করে যাচ্ছেন। সুদিন হয়তো আসবে। তখন আবার ভালো কাজ পাওয়া যাবে। সে প্রত্যাশায় ঢাকা ছাড়েননি। অন্যথায় গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ করতেন। কেস স্টাডি-২ : জাফরিন আহমেদ। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বিখ্যাত তেল, গ্যাস কোম্পানি শেভরনে চুক্তিতে কাজ করেছেন প্রায় ১০ বছর। চলতি বছরের শুরুতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পেও কাজ করেছেন কিছুদিন। এর পরও কভিড-১৯-এর মহামারী শুরু হলে কর্মহীন হয়ে পড়েন। পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন চালাতে নিজের পুঁজির সঙ্গে ব্যাংক ঋণ মিলিয়ে দুটি গাড়ি কিনে রেন্ট-এ কারের ব্যবসা পেতেছেন। সেখানে দুজনকে চাকরিও দিয়েছেন। তবে আয় কমে যাওয়ায় কর্মী দুজনকেও বেতন দিতে পারছেন না ঠিকমতো। এখন তার নতুন পরিকল্পনা চাকরি খোঁজার। কেস স্টাডি-৩ : মসিউর রহমান। বয়স ৩৩। দেশের একটি শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির শোরুমের ম্যানেজার ছিলেন। গত মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে টানা সাধারণ ছুটির সময় অঘোষিতভাবে ছাঁটাইয়ের শিকার হন। প্রায় পাঁচ মাসের বেশি বেকার থাকার পর গত মাসে জয়েন করেছেন একটি কফি বাজারজাতকরণ কোম্পানিতে। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে অন্যখানে। আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক বেতনে তাকে নতুন চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছে। তিনি জানান, এর আগে আর কখনই এতটা কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েননি পরিবার-পরিজন নিয়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথমত বেকার সমস্যা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। সরকারের উচিত স্বল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণিবিন্যাস করে পৃথক পরিকল্পনা করা। আর কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যায় শিক্ষিতদের কাজে লাগানো। ছোট ছোট ক্লাস্টারে ঋণ দিতে হবে। এ পরিস্থিতি এতটা দীর্ঘায়িত হবে তা আগে বোঝা যায়নি। এখনো সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না কত দিন থাকবে। তবে ধারণা করা যায়, এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে টানতে হবে মানবজাতিকে। যে কারণে কর্মসংস্থান, অর্থনীতিসহ সামগ্রিক পরিস্থিতিই এখন উদ্বেকজনক পর্যায়ে চলে গেছে। এজন্য মানুষকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে যে কোনো উপায়ে।’ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার আগে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে গড়ে ১২ জন বেকার ছিলেন। এখন তা বেড়ে প্রায় ২৫ জন হয়েছে। এর সঙ্গে আছে পুরনো ২৭ লাখ বেকার। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গত আগস্টে প্রকাশিত ‘ট্যাকলিং দ্য কভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার স্বল্পমেয়াদি প্রভাবে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হারাতে পারে ১১ লাখ ১৭ হাজার যুব শ্রমশক্তি। যদি ছয় মাসের প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে বেকার হতে পারে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার যুব শ্রমশক্তি। বাংলাদেশের তরুণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পে। প্রায় একই রকম তথ্য দিয়ে তৈরি পোশাক খাতের কর্মসংস্থান নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এ ছাড়া কৃষি, খুচরা বিক্রেতা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিবহনসহ সেবা খাতে নিয়োজিত তরুণরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মোট বেকারের প্রায় ৭৬ শতাংশ হতে পারেন এসব খাতের। শুধু বাংলাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপাল, পাকিস্তানেরও বেকার দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের তরুণ বেকারত্বের হার ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার বেকারত্বের হার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এশিয়া অঞ্চলে তরুণরা এমনিতেই শ্রমবাজারে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিলেন। করোনার কারণে ‘লকডাউন প্রজন্ম’ তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব দীর্ঘদিন থাকবে। সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীরা দলে দলে ফিরে এসেছেন জীবন বাঁচাতে। তারাও এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। আদৌ ফেরত যেতে পারবেন কিনা, ফেরত গেলে আবার একই কোম্পানিতে কাজ পাবেন কিনা- এসব নিয়ে চরম এক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আবার যারা বিদেশে রয়েছেন তাদের মধ্যে নতুন করে অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসছেন। স্থানীয় বেকারত্বের সঙ্গে প্রবাসীদের ফিরে আসার বিষয়টি একটি অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে চেপে বসছে দেশের অর্থনীতির ওপর। ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বলা মুশকিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর