বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

নতুন নামে অনলাইন এমএলএম রমরমা

ক্রাউড-১-এর ফাঁদ বিট কয়েন, ইথোরিয়াম গিফট কোডে পাচার হচ্ছে টাকা

মাহবুব মমতাজী

‘ঘরে বসে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব’-এমন প্রলোভনে নতুন নাম দিয়ে অনলাইনে চলছে এমএলএমের রমরমা বাণিজ্য। এরা বলছে, কোনো কাজ না করে শুধু বিজ্ঞাপনে ক্লিক, গেমিং করে অ্যাকাউন্টে জমা হবে ডলার বা ইউরো। ‘ক্রাউড-১’ নামে একটি ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুললেই এ ব্যবসা শুরু করা যাবে।

লোভনীয় আর চমকপ্রদ এ অবৈধ এমএলএম ব্যবসায় গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার মানুষ ঝুঁকে পড়েছেন বলে জানা গেছে। ওই কোম্পানিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে কিছু প্যাকেজ কিনতে হয়। আর ওই প্যাকেজের টাকা জমা দিতে হবে বিট কয়েন, ইথোরিয়াম, গিফট কোডের মাধ্যমে। অনলাইনে এই বাণিজ্যে বিট কয়েনের টাকা কয়েনবেজের মাধ্যমে বিকাশ অথবা রকেটে ট্রান্সফারের প্রলোভনও দেখাচ্ছেন ‘ক্রাউড-১’-এর রিওয়ার্ডধারীরা। এর আগে ২০১৭ সালে ‘ভিউক্যাশ’ নামে একটি ওয়েবসাইটে একই পদ্ধতিতে অনলাইন এমএলএম বাণিজ্য শুরু হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এ কোম্পানি বিট কয়েন কেনাবেচা করে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ মানি লন্ডারিং। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত রমজান থেকে দেশে ‘ক্রাউড-১’ নামের ওয়েবসাইটটির প্রচারণায় বেশ সরগরম। এখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে একটি স্পন্সর আইডির

প্রয়োজন। অর্থাৎ এ ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট আছে এমন কারও আইডি ব্যবহার করতে হবে। আর এই আইডি ব্যবহার করলে তিনটি ক্যাটাগরিতে খরচ করতে হবে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। ক্রাউড-১-এ যাদের অ্যাকাউন্ট আছে তাদের কাছ থেকে বিট কয়েন কিনতে হবে। এভাবে ক্রাউড-১-এ সদস্য হওয়ার পর প্রতিদিন ২৯টি বিজ্ঞাপন দেখলেই দুই থেকে তিন ডলার জমা হবে ব্যবহারকারী সদস্যের অ্যাকাউন্টে। তবে এ ডলারের অর্ধেক চলে যাবে আবার স্পন্সর আইডিধারী সদস্যদের অ্যাকাউন্টে। স্পন্সর আইডিধারীর মাধ্যমে যতজনই অ্যাকাউন্ট করবেন প্রত্যেকের আয় থেকে কিছু অংশ স্পন্সর আইডিতে চলে যাবে। এই ব্যবসা পরিচালনায় যুক্তদের নিয়ে প্রতি রাত ৯টায় জুম অ্যাপসে মিটিং করা হয়। তবে এরা প্যাকেজ কেনাবেচার কথা বললেও তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পণ্যের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ক্রাউড-১ বাংলাদেশ নামে একটি পাবলিক গ্রুপ রয়েছে, যেখানে সদস্যসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল এ প্রতিবেদককে বলেন, বিট কয়েন লেনদেন কিংবা কেনাবেচা সম্পূর্ণ অবৈধ। এতে মানি লন্ডারিং হয়। আর অনলাইন এমএলএমও অবৈধ ব্যবসা।

যেসব প্রচারণায় রয়েছে ক্রাউড-১ : তাদের ভাষ্যে, ক্রাউড-১ সুইডেনের একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করে। গত বছর ২৫ জানুয়ারি এটি নিবন্ধিত হয়। আর ১ আগস্ট শুরু হয় এর কার্যক্রম। ১১ মাসে এ কোম্পানিতে ২৩০টি দেশের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ডিস্ট্রিবিউটর বা আইডিধারী হন। এর সহযোগী দুই প্রতিষ্ঠান এফিলগো আর মিগস্টার। এফিলগো মোবাইল গেমিং ও এন্টারটেইনমেন্টের সার্ভিস প্রোভাইডর হিসেবে কাজ করে। আর মিগস্টার অনলাইন গেমিং, স্পোর্টস ও এন্টারটেইনমেন্টের ওপর কাজ করে। এ দুটো কোম্পানির ১০০ ভাগ লাভের ২০ ভাগ রাখে ক্রাউড-১। ৪০ ভাগ তার সদস্যদের তিন মাস পর পর বছরে চারবার দেওয়া হয়। আর বাকি ৪০ ভাগ যারা এখানে মার্কেটিং করছেন বা টিমওয়ার্ক করছেন তাদের জন্য। এই অনলাইন এমএলএমের সঙ্গে যুক্তদের একজন হলেন ডা. কিশোর। তার বাড়ি বরিশালে। থাকেন খুলনায়। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি ১০ বছর দুবাইয়ে ডাক্তারি করেছি। এরপর দেশে এসে এক মাস ধরে এ ব্যবসা করে আসছি। এই কদিনে আমি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো আয় করেছি। এটার কোনো অফিস নেই। ঘরে বসেই শুধু মোবাইলের মাধ্যমে এ ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। আমাদের দেশে এই কোম্পানির কয়েক লাখ মানুষ যুক্ত আছেন। এখানে যোগদান করতে হয় প্যাকেজ কিনে। আর প্যাকেজের জন্য পেমেন্ট করতে হয় বিট কয়েনে। আয়ও হয় বিট কয়েনে। এগুলো ক্রাউড-১ ওয়েবসাইটে থাকা অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পরে সেটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্যাশ করা যায়।’

যে পদ্ধতিতে যুক্ত করানো হয় : ক্রাউড-১-এ যুক্ত হওয়ার জন্য চারটি প্যাকেজের যে কোনো একটি কিনতে হয়। প্যাকেজগুলো হলো- ১. হোয়াইট প্যাকেজ, দাম ৯৯ ইউরো বা ১০ হাজার টাকা, ৯০ পয়েন্ট; ২. ব্ল্যাক প্যাকেজ, দাম ২৯৯ ইউরো বা ৩০ হাজার টাকা, ২৭০ পয়েন্ট; ৩. গোল্ড প্যাকেজ, দাম ৭৯৯ ইউরো বা ৮০ হাজার টাকা, ৭২০ পয়েন্ট; ৪. টাইটানিয়াম প্যাকেজ, দাম ২৪৯৯ ইউরো বা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২২৫০ পয়েন্ট। ইউটিউবে ছড়ানো ভিডিওতে মামুনুর রশিদ নামে একজন বলেন, ‘আপনি প্রথম প্যাকেজ হোয়াইট প্যাকেজ নিয়ে কাজ শুরু করলে ছয় ধরনের আয় করতে পারবেন। এর মধ্যে দুই ধরনের আয় হলো ননওয়ার্কিং আয় বা কাজ না করেও পাবেন ওনারশিপ বোনাস।’ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আপনি রহিম, করিম, খালেক, মালেক এই চারজনকে জয়েন করিয়েছিলেন। এই চারজন যদি ১০০ ইউরো আয় করেন, সেখান থেকে ১০ শতাংশ বা ১০ ইউরো আপনার অ্যাকাউন্টে চলে আসবে।’

ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ক্রাউড-১-এর অফিস রয়েছে সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে, ফিলিপাইনের ম্যানিলায়, সুইডেনের স্টকহোমে, স্পেনের মাদ্রিদ ও মালাগায় এবং ইংল্যান্ডের লন্ডনে। এ ছাড়া কলাম্বিয়া, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, হংকং ও কেনিয়ায় তাদের নতুন অফিস চালুর কথা রয়েছে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর