মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

চাষের মাছে পুষ্টি পূরণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

চাষের মাছে পুষ্টি পূরণ

চাষের মাছেই এখন পূরণ হচ্ছে দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা। বছর বিশেক আগেও দেশে চাহিদা অনুসারে মাছের জোগান মিলত না। রুই আর পাঙ্গাশ প্রকৃতির কিছু মাছ ছাড়া খুব কম মাছ চাষ হতো তখন। খাল-বিল-নদী কিংবা পুকুরে প্রাকৃতিকভাবে যা উৎপাদন হতো তা দিয়েই চলত। মানুষের চাহিদাই পূরণ হতো না। আর মাঝারি ও ছোট দেশি মাছ ছিল প্রায় বিলুপ্তির পথে। দেশি পাবদা, শিং, মাগুর, কই, এসব মাছ ছিল হারিয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু এখন আর সেই অভাব নেই। নেই দেশি মাছ না পাওয়ার হা-হুতাশ। হারিয়ে যাওয়া দেশীয় মাছের সংরক্ষণ ও নতুন করে চাষাবাদের জন্য চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘জিন ব্যাংক’ উদ্ভাবন করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। বিলুপ্তির পথে থাকা ৬৪ প্রজাতির মাছ ইতিমধ্যেই এতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, প্রচলিত মাছ ছাড়াও অপ্রচলিত প্রজাতির মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ করে তার পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে কাঁকড়া, শামুক ও সামুদ্রিক শৈবাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনসহ চাষাবাদের কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে জানান মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) রিপোর্ট অনুযায়ী, বিগত ১০ বছরের হিসাবে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। প্রাকৃতিক জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব ও উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম গ্রহণের ফলে মৎস্য উৎপাদনে দেশের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মাছের খামারিদের এবার আর্থিকসহ সব সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে ‘ফিশ ফিড’ উৎপাদন/ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হবে মাছচাষিদের। যারা এসব ফিড বিদেশ থেকে আমদানি করতে চাইবেন তাদের শুল্ক সুবিধা দেবে সরকার। তাছাড়া যারা বন্যা বা করোনার মতো দুর্যোগ বা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এই চাষি বা খামারিদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে।    

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আরও জানান, অপ্রচলিত প্রজাতির মৎস্য সম্পদকে শিগগিরই কৃষকদের মাধ্যমে ব্যাপক ভিত্তিতে চাষাবাদের আওতায় আনা হবে। কারণ কাঁকড়াসহ এসব অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আগে দেশের নদী বা সাগর থেকে কাঁকড়ার পোনা সংগ্রহ করে চাষ করা হতো। এখন কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে চাষিদের মাঝে। গত ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪টি নতুন জাতের মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনসহ এবং ৭০টি উন্নত প্রযুক্তি ও চাষাবাদ কৌশল মৎস্যচাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এসব মাছ এখন নদী ও খাল-বিল ছাড়াও কৃষকের খামার কিংবা পুকুরেও উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে রুই, কই, পাঙ্গাশ, কাতলা, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প ও চিংড়ির দাম কমেছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে ব্যাপক পরিমাণের মিঠা পানির মাছ এখন বিদেশেও রপ্তানি শুরু হয়েছে।       

পাঙ্গাশ আর রুই মাছ দেশব্যাপী শিশুদের কাছে খুবই প্রিয়। এর মাধ্যমে শিশুদের আমিষের অভাব পূরণ হচ্ছে। বেশি দামের মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের ক্ষেত্রে এই পাঙ্গাশই মাংসের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া পুঁটি, টেংরা, মলা, ডেলা, কাচকি থেকে শুরু করে ডারকিনা পর্যন্ত ছোটো বড় সব ধরনের মাছই এখন চাষ হচ্ছে সারা দেশে। যশোরের অভয়নগরে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাবদা মাছ চাষ করে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। স্বল্প জমিতে অল্প খরচে মাছ চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এলাকার আলহাজ এনামুল হক বাবুল।

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ অতীতের ওই সুখস্মৃতি এক সময় হারিয়ে গিয়েছিল। গত দেড় দশকে উন্নত জাতের চাষ বাঙালির সঙ্গে মাছের সখ্যকে আবারও ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে দেশের মৎস্যবিজ্ঞানী ও চাষিদের সম্মিলিত চেষ্টায়। এফএওর মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের যে দেশগুলোতে মাছের চাষ বেশি বাড়বে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই ছোট্ট দেশটি এ বছরও মিষ্টি পানিতে মাছ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। ধান বা পাট রাখার জন্য সরকারি গুদাম থাকলেও মাছ রাখার জন্য এখনো কোনো হিমাগার নেই। তারপরও মৎস্য খাতে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ বলছে এফএও। বাংলাদেশের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ফিশারিজ বিভাগ রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাছ চাষের নতুন জাত ও উন্নত চাষ পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া মৎস্যবিদরা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মৎস্যচাষিদের সহায়তা দিচ্ছেন। তাদের গবেষণায় চট্টগ্রামে ইলিশ এবং ময়মনসিংহে মহাশোল মাছেরও চাষ শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। বর্তমানে বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে দেশি চিতল, ফলি, খইলশা, বাইলা, আইড়, বাগাইড়, বাইম, শোল, দেশি ভেটকি, ভেদা/মেনি, টাকি, মাগুর, বাঁশপাতা/দেবারি, বাঁশপাতা/বাটা, পুঁটি, কাচকি, কাজুলি, কালিবাউস, কাচোন পুঁটি, কানি পাবদা, কানি টেংরা, কাঁঠালপাতা, কাতল, লাল খলশে, লম্বা চাঁদা, বোয়াল, বৌমাছ/রানি, মোরারী, কই, চন্দনা ইলিশ, গণি চাপিলা, চেলা, গাং টেংরা, গুলসা টেংরা, গিলি পুঁটি, গজার, গ্রাস কার্প, গুরা ট্যাঙ্গরা, গুতুম, ঘনিয়া, কাইকা, ইলিশ, মলা পুঁটি, মলা, মৃগেল, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, মহাশোল, রাজপুঁটি, রাঙ্গা চান্দা, রুই, শাপলা পাটা, দেশি দাড়কিনা, পাতি দাড়কিনা, দাড়কিনা, পাঙ্গাশ, সাদা ঘনিয়া, সিলভার কার্প, ছোট মাগুর, তারা বাইম, টেংরা, টিয়াশোল, তেলাপিয়া ইত্যাদি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর