মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

৮ টাকার আলু কেন পঞ্চাশে

কৃষি বিপণন অধিদফতরের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

৮ টাকার আলু কেন পঞ্চাশে

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদন, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সবজিটির দাম বৃদ্ধির জন্য বন্যা, অতিবৃষ্টি, করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারি ত্রাণ হিসেবে আলু বিতরণ এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্র্তৃক আলু কিনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণের কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে। একই  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার বাজারে যে আলুটি বিক্রি হচ্ছে কৃষক পর্যায়ে তার উৎপাদন খরচ ছিল কেজিপ্রতি ৮ টাকা ৩২ পয়সা।

আলুর উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ ও সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে সার্বিক এই প্রতিবেদনটি তৈরি করছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত আগস্টে তারা আলুর উৎপাদন এলাকা, হিমাগার এবং পাইকারি ও খুচরা বাজারে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। এরপর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সেটি কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

আলুর সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধির কারণগুলো উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয় : (১) কভিড-১৯ সংক্রমণ শুরুর পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ত্রাণ বাস্কেটে আলুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে এপ্রিল-মে মাসে প্রচুর পরিমাণ আলু সরকারি ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়; (২) গত অর্থবছরে আলু রপ্তানি আগের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেড়েছে, যা আলুর চাহিদা বাড়ার একটি বড় কারণ; (৩) সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে মৌসুমি শাক-সবজি নষ্ট হওয়ায় আলুর বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে; (৪) কভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতির শুরুর দিকে খাদ্য সংকট ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কায় চাল, আলুসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য কৃষক ও গৃহস্থ পর্যায়ে সংরক্ষণ করায় সরবরাহ কমেছে; (৫) ইউএনডিপি কর্তৃক আলু ক্রয় করে সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ করায় আলুর মোট সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে, ফলে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং (৬) আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষ করে ভারত ও নেপালে আলুর দাম বাড়ার কারণেও বাংলাদেশি আলুর কদর বেড়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত মৌসুমে আলুর দাম কম থাকায় এবার কভিড-১৯ এর কারণে দরিদ্র মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের জন্য আলু দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যেও খাদ্য হিসেবে আলু বিতরণ হয়েছে। বারবার বন্যার কারণে অন্যান্য সবজি নষ্ট হয়েছে। সচিব জানান, ২০১৭-১৮ মৌসুমে আলুর দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-কে অনুরোধ করা হয়েছিল তারা যেন রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য হিসেবে আলুর বিতরণ বাড়ায়। এ বিষয়ে ওই সময় টেলিফোনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে তাগিদও দেওয়া হয়েছিল। তবে সে সময় আলু ব্যবহার না করলেও এবার রোহিঙ্গাদের খাদ্য হিসেবে বিপুল পরিমাণ আলু ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব। কৃষি সচিব বলেন, চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টির পাশাপাশি বারবার বন্যার কারণে কৃষকের সবজি ফলন নষ্ট হয়েছে। এতে আলুর ওপর ভোক্তার অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে। নতুন আলু আসার পর এক দেড় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

আলুর উৎপাদন ও চাহিদা কত : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৯ লাখ মেট্রিক টন আলু হয়েছে। দেশে আলুর চাহিদা ৭০ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। তবে সরকারি এই তথ্যের বিপরীতে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তারা বলেন, ২০১৯-২০ মৌসুমে ৯০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে বছরে আলুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বীজ আলু দরকার প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন। সংরক্ষণ পর্যায়ে কিছু নষ্ট ও অপচয় হয়। এ ছাড়া বিদেশে রপ্তানিও হয় কিছু আলু। গত আগস্টে কৃষি বিপণন অধিদফতর যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে ৩৬৯টি হিমাগার চালু আছে, যেখানে ৩০ লাখ মেট্রিক টন আলু মজুদ আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদনের ২৭ শতাংশ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট আলু কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ হয়ে থাকে।  কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এবার তারা আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম আলু সংরক্ষণ করেছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর তারা ৫৫ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করেছিল।

আলুর প্রকৃত দাম কত : কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা আলুর দাম বাড়ার কারণগুলো খুঁজতে গিয়ে সবজিটির উৎপাদন ও প্রকৃত দাম বের করার চেষ্টা করেছেন। তাদের হিসাবে, এখন যে আলুটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তার উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ১৪ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া কেজিতে ৩ টাকা ৬৬ পয়সা, গ্রেডিং চার্জ ৪৫ পয়সা, ওজন হ্রাস ৮৮ পয়সা ধরে প্রতি কেজি আলুর হিমাগার গেটে দাম পড়ে ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা। কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, গত মার্চে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় বাংলাদেশে, তখনো সবজিটি হিমাগার পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ২২ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে। সেই সময়ও সংরক্ষণকারী আলু ব্যবসায়ীর লাভ ছিল কেজিতে ৩ টাকা ৫১ পয়সা। প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে হিমাগার ব্যবসায়ীরা আলু খালাস বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ও অবৈধ মজুদ গড়ে তুলে। তারা চাহিদার তুলনায় কম আলু খালাস করে হিমাগার পর্যায়ে সবজিটির দাম ২৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। ফলে গত আগস্টে সেই আলু খুচরা বাজারে এসে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হয়।

অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, তারা গতকাল হিমাগার গেটে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে। ফলে প্রতি কেজি আলুতে হিমাগার ব্যবসায়ীরা মুনাফা করছেন ২০ থেকে ২২ টাকা, যা শুধু অস্বাভাবিক নয়, অন্যায্য। প্রতিবেদনে হিমাগার মালিকদের বিরুদ্ধে আলুর কৃত্রিম সংকট বা অবৈধ মজুদ গড়ে তোলার অভিযাগ করে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে অতিরিক্ত মুনাফার বিষয়টি প্রতীয়মান হচ্ছে। হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোশারফ হোসেন সরকারি সংস্থার করা ‘কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ’ অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, তারা উল্টো হিমাগার মালিকদের চিঠি দিয়ে আলু ছাড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন, যাতে ভোক্তা পর্যায়ে সবজিটির দাম কমে আসে। তবে আলুর দাম ৫০ টাকায় ওঠায় তারা নিজেরাও অস্বস্তিতে আছেন- এমন মন্তব্য করে মোশারফ হোসেন বলেন, বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে কৃষকরা ভাবছে এবার নতুন আলু আসতে দেরি হবে। এ ছাড়া গত মৌসুমে আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। এ কারণে তারা আলু কম ছাড়ছে। আর এই বাড়তি মূল্য কৃষক এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটেই ঢুকছে বলে জানান তিনি। কিন্তু কৃষক ব্যতীত এই মধ্যস্বত্বভোগী কারা, হিমাগার মালিক না পাইকারি ব্যবসায়ী- এর ব্যাখ্যা কৃষি মন্ত্রণালয় বা কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন কেউ দিতে পারেনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর