বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

আগে ফাঁদ, তারপর ধর্ষণ

বেশির ভাগ কম বয়সীকে ফাঁদে ধর্ষণ, বয়স্ক নারীকে প্রলোভন দেখাচ্ছে ধর্ষক

জিন্নাতুন নূর

আগে ফাঁদ, তারপর ধর্ষণ

ধর্ষকরা আগে ফাঁদ ফেলছে তারপর করছে ধর্ষণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশেষজ্ঞরা দুই ধরনের ঘটনা চিহ্নিত করেছেন : এক. নিঃসঙ্গ অবস্থার সুযোগে ধর্ষণ, দুই. প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে নারীর একাকী চলাচলের ওপরও আছে হুমকি। দেখা যাচ্ছে যে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে আশপাশের পরিচিতরাই শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারীদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করছে। এক্ষেত্রে নারীদের সঙ্গে ধর্ষকরা মিথ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, মডেল বানানোর আশ্বাস দিয়ে, আপত্তিকর ছবি ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে এবং কখনো চাকরি দেওয়ার আশ্বাসে ধর্ষণ করছে। শিশুদের ক্ষেত্রে খাবারের লোভ দেখিয়ে আবার কিছু ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। দুর্বৃত্তরা ফাঁদে ফেলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ও সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমকে হাতিয়ার করছে। এসব মাধ্যমে প্রথম বন্ধুত্ব গড়ে তুলে বিশ্বাস অর্জন করে পরে দেখা করার কথা বলে নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষনের আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম বয়সীদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। আর ধর্ষকরা ভুক্তভোগীর ‘এজ গ্রুপের’ সঙ্গে মিলিয়ে তাকে ফাঁদ ফেলছে।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপপুলিশ কমিশনার হামিদা পারভীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিভিন্ন কেস পর্যালোচনা করে দেখেছি যে ধর্ষকরা সাধারণত ভুক্তভোগীকে ‘এজ গ্রুপের’ সঙ্গে মিলিয়ে ফাঁদ ফেলে। কাকে কোন ফাঁদে ফেলে তারা ধর্ষণ করবে তা আগেই পরিকল্পনা করে নেয়। মামলা বিশ্লেষণ করে দেখেছি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে শিশু ও বয়স্ক নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্যই ফাঁদ ফেলা হয়। বিশেষ করে কমবয়সী ভুক্তভোগী শিশুদের অবশ্যই ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করা হয়। আর বিভিন্ন বয়সী নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে কিছুক্ষেত্রে মিথ্যা সম্পর্কের ফাঁদ পেতেও ধর্ষণ করা হচ্ছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীর ওপর বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে যৌন সহিংসতা চালানো হচ্ছে। সহিংসতা চালানোর আগে একেকজন নারীকে একক ধরনের ফাঁদে ফেলে অত্যাচার করা হয়। সাধারণত নারী ও শিশুদের প্রয়োজন বুঝেই দুর্বৃত্তরা ভুক্তভোগীকে ফাঁদে ফেলে। এক্ষেত্রে কোনো শিশু আইসক্রিম খেতে পছন্দ করলে তাকে আইসক্রিম খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়। তিনি বলেন, ফাঁদে ফেলে এভাবে ধর্ষণ করায় দুর্বৃত্তদের পক্ষে ঘৃণ্য এই অপরাধ ঘটানো সহজ হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন-এর প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, দেশে মানবিক গুণসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষের খুব অভাব। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বোধেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। মানুষকে প্রলোভিত হওয়ার আগে সে এ বিষয়ে কতটা সচেতন তা ভাবতে হবে। কিন্তু এ সম্পর্কে ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। আবার প্রলোভিত হওয়ার পর তা যাচাই করে দেখার ক্ষমতা কয়জনের আছে! কিন্তু দেশে প্রলোভিত হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। আবার যারা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করছে তারা জানে কাকে কীভাবে প্রলোভিত করতে হবে।

কেস স্টাডি-১ : শরীয়তপুরের আলোচিত ধর্ষণ মামলার আসামি আরিফ হোসেন গোপন ক্যামেরা বসিয়ে নারীদের আপত্তিকর ছবি ধারণ করে সেই ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের ধর্ষণ করতেন। এভাবে ফাঁদে ফেলে আরিফ অন্তত ছয়জন নারীকে ধর্ষণ করেছে। সম্প্রতি ধারণকৃত নারীদের ভিডিও গ্রামের মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়লে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং আরিফের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

কেস স্টাডি-২ : হৃদয় নামের আরেক যুবক লাইকি, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও আপলোড করেন। নিজেকে পরিচয় দেন মডেল ও পরিচালক বলে। এরপর কিশোরীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে মডেল বানানোর কথা বলে বাসায় এনে ধর্ষণ করেন। হৃদয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ সে বিভিন্ন প্রলোভনে উঠতি বয়সী পাঁচ কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ভুক্তভোগী এক ছাত্রী রাজধানীর ভাটারা থানায় হৃদয়ের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনে। অভিযোগে বলা হয় গত ১৬ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কুড়িলে অভিযুক্তের বাসায় চার ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। পুলিশের দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযোগের সততা স্বীকার করেছে অভিযুক্ত হৃদয়। কেস স্টাডি-৩ : গাজীপুরের শ্রীপুরে দুই নারী পোশাককর্মী সম্প্রতি গণধর্ষণের শিকার হন। শ্রীপুর থানা সূত্রে জানা যায় অভিযুক্তরা মুঠোফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে ভুক্তভোগী দুই পোশাককর্মীর একজনের সঙ্গে। এরপর ফোন দিয়ে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগীকে দেখা করতে বলে। পরে ভুক্তভোগী তার আরেক সহকর্মীকে নিয়ে দেখা করতে এলে তাদের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। কেস স্টাডি-৪ : গত জুন মাসে শরীয়তপুরে আট বছর বসয়ী দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া শিশুকে খাবারের লোভ দেখিয়ে ঘরে ডেকে এনে ধর্ষণ করে বখাটে মিন্টু মন্ডল নামের যুবক। ধর্ষণ শেষে এ ঘটনা কাউকে বললে শিশুটিকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় অভিযুক্ত ধর্ষক।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর