মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় যৌতুক দেওয়া নেওয়া দুই-ই বেড়েছে

জিন্নাতুন নূর

করোনায় যৌতুক দেওয়া নেওয়া দুই-ই বেড়েছে

বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সমাজে যৌতুক প্রথা এখনো কমেনি। উল্টো শিক্ষার হার বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা এবং এজন্য দায়েরকৃত মামলার সংখ্যাও বেশি। মোট কথা, সামাজিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে যৌতুকের অভিশাপমুক্ত হয়নি দেশ। প্রেমের সম্পর্ক থেকে বিয়ে কিংবা অভিভাবকদের ঠিক করে দেওয়া বিয়ে সব ক্ষেত্রেই এখন যৌতুকের জন্য কনেপক্ষকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিয়ের দীর্ঘদিন পরও কিছু কিছু পরিবার থেকে যৌতুকের জন্য মেয়েটিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। আর যৌতুক দিতে অস্বীকৃতি জানালেই ভুক্তভোগীর ওপর নেমে আসছে অমানুষিক নির্যাতন। কখনো করা হচ্ছে ধর্ষণ, কখনো ছুড়ে মারা হচ্ছে অ্যাসিড, আবার নির্মম নির্যাতনে কখনো প্রাণ দিতে হচ্ছে অসহায় নারীকে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন মোাট ৭৩ জন নারী। নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয় ৬৬ জনের। এ কারণে মোট ১১৫টি মামলা দায়ের করা হয়। আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ১৭ জন। অত্যাচার সইতে না পেরে স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান ১২ জন। তবে করোনাকালে যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, গত বছর এ কারণে মোট শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৬২ জন। আর নির্যাতনের কারণে মোট ৯৭টি মামলা করা হয়। দেখা যায়, নির্যাতিত নারীর মধ্যে ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে অনেক পরিবারে আয়-রোজগার কমে গেছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আবার শিক্ষিত যে পরিবারের ছেলেরা আগে হয়তো যৌতুকের জন্য তার স্ত্রীর ওপর চাপ দেওয়ার কথা ভাবতেন না তারাও এখন স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অর্থ এনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এ সবকিছুই করোনাকালে যৌতুক প্রথাকে উসকে দিয়েছে। দেশে যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও আইনটির নানা ফাঁকফোকর থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। এ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে- মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেনমোহর, মোহরানা অথবা বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিয়ের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহারসামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কিন্তু আইনের এ ব্যাখ্যার সুযোগে মূল্যবান অনেক সামগ্রী যৌতুকের নামে এখন দেওয়া-নেওয়া চলছে। সাধারণত দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়েতে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মাঠের হাঠ নামক এলাকার কুলসুম আক্তারকে (১৪) তার বাবা আবদুল মোতালেব করোনাকালে বিয়ে দেন। দিনমজুর মোতালেবকে তার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা ধার করতে হয়। এ টাকা বিয়ের আগেই ছেলেপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তা না হলে মোতালেব মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন না। তবে শুধু মোতালেব একা নন, তার মতো এ গ্রামের অন্য বাবাদেরও মেয়ের বিয়ে দিতে হলে ছেলেপক্ষকে যৌতুক দিতে হয়। ৫০ হাজার টাকার কমে এ গ্রামে কোনো বাবা-মা তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেন না বলেও জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, ঢাকাসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও যৌতুকের জন্য কনেপক্ষকে বিব্রত হতে হয়।

একসময় যৌতুক হিসেবে কনেপক্ষ থেকে বরপক্ষ নগদ অর্থ ও আসবাবপত্র নিলেও বর্তমানে নগদ অর্থ ছাড়াও দামি উপহারসামগ্রী, জমি, যানবাহন ও ফ্ল্যাট ইত্যাদি দাবি করছে। যৌতুক দেওয়া-নেওয়া এবং এর পরিমাণের বিষয়টি মূলত নির্ভর করে মেয়ের অভিভাবকের আর্থিক সচ্ছলতার ওপর। যদি মেয়েপক্ষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় তবে যৌতুকের পরিমাণও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। আবার শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারগুলোয় শ্বশুরবাড়ির কটুকথার ভয়েই মেয়ের মা-বাবা বিয়ের সময় সংসার গুছিয়ে দেওয়ার নামে পাত্র ও তার পরিবারের জন্য দামি আসবাবপত্র, ফ্ল্যাট, গাড়ি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কিনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এত কিছু করেও অনেক সময় পাত্র ও তার পরিবারের মন পাচ্ছে না অভাগা মেয়েটি। ছেলেপক্ষের চাহিদার তালিকা যেন শেষই হতে চায় না। এরপর কেউ কেউ ছেলের বিদেশে যাওয়ার জন্য যাবতীয় খরচ, কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যবসা করার জন্য মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ চেয়ে নেওয়া হচ্ছে। দেখা যায়, বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকেও যৌতুকের জন্য চাপ দিয়ে তা না পেয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে কিছু ছেলে ও তার পরিবার। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় যৌতুকের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না এটি দুঃখজনক। আবার কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদের এ মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মামলাগুলো গতি হারিয়ে ফেলছে। তবে ঘৃণ্য এ প্রথা শুধু আইন প্রয়োগে বন্ধ করা যাবে না, এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।’

সর্বশেষ খবর