মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

চালের দাম বাড়াতে ধান মজুদ করছেন মিল মালিকরা

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদন

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

অটো রাইসমিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে বিপুল পরিমাণ ধান কিনে মজুদ করছেন। মজুদ সে ধান থেকে উৎপাদিত চাল কম পরিমাণে বাজারে ছেড়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মিলগেট মালিকরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে চাল কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা বৃদ্ধি করায় পাইকারি আড়তে বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে। ফলে খুচরা পর্যায়ে খাদ্যপণ্যটির দাম বেড়েছে আরও বেশি। সারা দেশে চালের উৎপাদন, মজুদ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে মিল মালিকদের এ সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়েছে। সেপ্টেম্বরের তথ্য নিয়ে গত ১৪ অক্টোবর তৈরি করা এ প্রতিবেদনটি গতকাল খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনের মন্তব্য অংশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যেসব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে : ১. সরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ না নেওয়ার সুযোগে সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর যোগসাজশে চাল ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধির তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়; ২. দেশে ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও অযৌক্তিকভাবে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাজার মনিটরিং দুর্বলতার জন্য হচ্ছে এবং ৩. দেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত মিলার, চাতাল মালিক, আড়তদার, মোকাম মালিক, মজুদদার, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। পাশাপাশি যেসব জেলায় অতিরিক্ত চাল মজুদ রয়েছে সেগুলো অন্য জেলায় সরবরাহ করা, ভ্রাম্যমাণ বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারিভাবে পর্যাপ্ত চাল মজুদ করতে খাদ্য অধিদফতরকে নির্দেশনা দেওয়া, দেশে চালের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করে সংকটকালের জন্য প্রয়োজন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল আমদানির পরিকল্পনা করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবদেনে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কিছু কিছু জায়গায় তারা ধান-চাল অবৈধভাবে মজুদের তথ্য পেয়েছেন এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। পরে যাতে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট করে মিলগেটে চালের দাম বাড়ানো না হয়, সে লক্ষ্যে খাদ্যপণ্যটির মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান খাদ্য সচিব। সমন্বয়হীনতা সম্পর্কে নাজমানারা খানুম বলেন, ‘খাদ্যপণ্য নিয়ে একেক প্রতিষ্ঠানের একেক ধরনের কাজ। সবকিছু আমরা করতে পারি না। আমরা মিলগেটে দাম বেঁধে দিয়েছি, সেখানে চালের দাম বাড়লে তা আমরা দেখব। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়লে তার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুচরা বাজার মনিটরিং করবে। সেটি আমাদের কাজ নয়।’ আমদানির বিষয়ে খাদ্য সচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে তিনটি বিষয়ে অনুমতি দিয়ে রেখেছেন। ফলে যে কোনো প্রয়োজনে আমরা সরকার টু সরকার পর্যায়ে খাদ্য আমদানির পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও আমদানির উদ্যোগ নিতে পারব। প্রয়োজনে খাদ্য আমদানিতে শুল্ককর হ্রাস করে দেওয়া হবে। এজন্য নতুন করে কোনো ধরনের অনুমতির প্রয়োজন হবে না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারকে ভোক্তার পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় রাখতে হয়। এ কারণে এখনই খাদ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। যদি আউশ উৎপাদন কম হয়, তখন আমদানির বিষয়টি ভাবা হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে চালের দাম বাড়ার পেছনে মিল মালিক সিন্ডিকেট ও মজুদদারি ছাড়াও করোনাভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল রপ্তানি বন্ধ করা এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে আউশের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বছর ৩৫ জেলায় কয়েক দফা বন্যার কারণে আউশ মৌসুমে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশে চাহিদার তুলনায় চালের মজুদ কম এবং করোনা পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারক দেশগুলো চাল রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার গুজবে মিল মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় মিলগেটে চালের দাম বাড়িয়ে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া আবহাওয়ার কারণে চালকল সচল না থাকা এবং ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টির কারণে চাল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় চালের দাম বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে চালের দাম বাড়ার পেছনে উত্তরবঙ্গের চালকল ও চাতাল মালিকদের ভূমিকা তুলে ধরে বলা হয়েছে, তারা বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের বড় অংশ কিনে মজুদ করেছেন। ধান মজুদের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বহু চাতাল মালিক চাল উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। এতে কুষ্টিয়া জেলার মোকামে চালের বাড়তি চাহিদা তৈরির অজুহাতে মোকাম মালিকরা দাম বাড়িয়েছেন।

দেশের চালের সবচেয়ে বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরের ২৬ সেপ্টেম্বরের তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, ওই সময় প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ওই মোকামে মোটা চাল এবং মিলগেটে মিনিকেট, পাইজাম, কাজললতা, বাসমতীর দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সংগ্রহে ঘাটতি : এ বছর বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও সরকারিভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে এ মৌসুমে ২ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। চলতি আউশ থেকে ৩৪ লাখ মেট্রিক টন এবং আমন থেকে প্রায় ১৫৫ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে। দেশে বার্ষিক খাদ্য চাহিদার পরিমাণ ২ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর বোরো মৌসুমে ১৬ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন ধান/চাল সংগ্রহের লক্ষ্য থাকলেও ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৯৯ হাজার ২৬ মেট্রিক টন খাদ্য সংগ্রহ হয়েছে। বোরো মৌসুম থেকে সরকারি সংগ্রহ পর্যায়ে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। তবে সরকারি পর্যায়ে সংগ্রহ কম হলেও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৫৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।

সর্বশেষ খবর