বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

মানুষ গড়ার কারিগররাই করছেন জাল সনদে চাকরি

ভুয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ

আকতারুজ্জামান

ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ফাতেমা খাতুন। জাল ‘শিক্ষক নিবন্ধন সনদ’ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন তিনি। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) সূত্র বলছে, ফাতেমা খাতুন নামে অপর নারীর সনদ কাজে লাগিয়ে জালিয়াতি করেছেন প্রভাষক ফাতেমা। চাকরিরত ফাতেমা খাতুনের বাবা ইয়াকুব আলী হলেও সনদের প্রকৃত মালিক ফাতেমা খাতুনের বাবার নাম আবদুল লতিফ। এনটিআরসিএ বলছে, ফাতেমা খাতুন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন তা প্রমাণিত। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এনটিআরসিএ-কে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অধ্যক্ষকে। শুধু ফাতেমা খাতুন নন, সারা দেশে হাজার হাজার শিক্ষক জাল সনদে মানুষ গড়ার কারিগর নামক শিক্ষকতার পেশায় রয়েছেন। এই ব্যক্তিরা জালিয়াতি করে চাকরি নিয়ে সরকারের কোষাগার থেকে আত্মসাৎ করছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মজিদ মন্ডল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ফাতেমা খাতুন নিবন্ধন সনদ দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ২০১৫ সালে চাকরির ইনডেক্স নম্বর দেখিয়ে তিনি এ কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এনটিআরসিএ থেকে পাঠানো চিঠি পেলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানান, অভিযুক্ত ফাতেমা খাতুন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির আপন বোন হওয়ায় জালিয়াতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। সূত্র জানান, রংপুরের পীরগঞ্জে সরকারি শাহ আবদুর রউফ কলেজের আটজন শিক্ষক বছরের পর বছর জাল সনদে চাকরি করে যাচ্ছেন। এরা হচ্ছেন সুরাইয়া বেগম, জিল্লুর রহমান, হুরুননাহার খাতুন, হাসিনা আকতার, শহীদ বদরুদ্দোজা, ফারহানা খাতুন, আয়েশা প্রধান দীপ্তি ও কেয়া শারমিন। এদের বিরুদ্ধেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মামলা করতে বলেছে এনটিআরসিএ। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে মাগুরা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক লতিফুজ্জামান ও মনিকা রানী রায়ের সনদ ভুয়া। রংপুরে বদরগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রভাষক শামীম আল মামুনও করছেন জাল সনদে চাকরি। তিনি সফিকুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তির সনদকে ব্যবহার করে চাকরি করছেন বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ বন্দরে সরকারি কদম রসুল কলেজের প্রভাষক লিপি আক্তার দশম শিক্ষক নিবন্ধনের মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন। দেখা গেছে, মাহবুবা খাতুন নামে অন্য ব্যক্তির সনদ দিয়ে তিনি চাকরি করছেন। নওগাঁয় নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক আরশাদ আলী ও সরোজ কুমার দাশের এনটিআরসিএ সনদও ভুয়া। তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চাকরি করছেন বলে জানা গেছে। একই জেলার মান্দা থানা আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক পাপিয়া খান। তৃতীয় শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ দেখিয়ে তিনি চাকরিতে ঢুকেছেন। এনটিআরসিএ সূত্র বলছে, তার দাখিলকৃত সনদটি জাল ও ভুয়া। নওগাঁ সদরে চুনিয়াগাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী মৌলভি মো. মামুনুর রশীদ। তিনিও চাকরি নিয়েছেন ভুয়া সনদ দিয়ে। সারা দেশে হাজার হাজার শিক্ষক এভাবে জাল সনদে চাকরি করছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় শিক্ষক নামধারী ব্যক্তিদের এমন অপরাধ বাড়ছে। শিক্ষক পদের অযোগ্য এই মানুষগুলো ভুয়া সনদের মাধ্যমে শিক্ষকতার পেশায় ঢুকে একদিকে যেমন মহান এ পেশাকে কলঙ্কিত করছেন, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও গড়ে তুলতে পারছেন না প্রকৃত মানুষ হিসেবে। শিক্ষাবিদসহ শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো পেশাতেই জাল সনদে চাকরি করা অপরাধ। আর ভুয়া সনদের মাধ্যমে কোনো অযোগ্য ব্যক্তি যদি শিক্ষক হয়ে যান, তবে সেটি জাতির জন্য ভয়ঙ্কর। শিক্ষকতার পেশায় অযোগ্য ব্যক্তিরা ঢুকে গেলে তা জাতির মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার কারণ হিসেবে কাজ করবে। অবিলম্বে এই অযোগ্যদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান মো. আকরাম হোসেন বলেন, ‘এমপিওভুক্ত বা জাতীয়করণের পর সনদ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এনটিআরসিএতে পাঠান শিক্ষকরা। জালিয়াতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই আমাদের। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করা হয়।’

তিনি বলেন, যারা জাল সনদে শিক্ষকতার চাকরি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তথ্যমতে, শিক্ষাক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাধ্যতামূলক, সরকারি নিয়ম-নীতি অনুসরণ, সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহার এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিতকরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)’ রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটিও শিক্ষকদের জাল সনদসহ নানা অনিয়ম তুলে ধরে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে। কিন্তু জাল সনদ ধরতে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অনীহা রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ। তবে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর বলেন, শিক্ষকদের জাল সনদ চিহ্নিতকরণ একটি রুটিন দায়িত্ব। প্রতি মাসেই জাল ও ভুয়া সনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

সর্বশেষ খবর