মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

গরুর ব্যাপারী সেজে দুই বছর পর খুনি শনাক্ত

মাহবুব মমতাজী

রাজধানীর দক্ষিণখানে পূর্ব মোল্লার টেকে ভাড়া বাসায় এক গৃহবধূর লাশ পাওয়া যায়। ওই গৃহবধূর নাম সান্ত্বনা আক্তার সুমি (২৫)। উদ্ধারের সময় লাশের গলায় ওড়না পেঁচানো ছিল। শুরুতে আশপাশের লোকজনের ধারণা ছিল, এটি আত্মহত্যা। কিন্তু ওই গৃহবধূর স্বামী লাপাত্তা হওয়ায় তা সন্দেহে মোড় নেয়। এ ঘটনা ২০১৮ সালের ১২ আগস্টের। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। ওই বছরই ২৩ সেপ্টেম্বর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পান তদন্ত কর্মকর্তারা। রিপোর্টে শ্বাসরোধে হত্যার কথা বলা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হন- এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যা। কিন্তু খুনিকে শনাক্ত করতে হিমশিম খায় পুলিশ। থানা পুলিশ হয়ে তদন্তভার চলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। তদন্তে দিন, মাস শেষে বছরও চলে যায়। প্রযুক্তির সহায়তায় খুনির অবস্থান শনাক্ত হয় বগুড়ায়। কিন্তু সেখানে সন্দেহভাজন খুনি নেই। এভাবে চলে যায় আরও এক বছর। এরপর খুনিকে বের করতে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের গরুর খামারে পাঠানো হয় ব্যাপারী। ব্যাপারী সেজে গরু কেনার নামে একে একে গরুর এই খামার, ওই খামার ঘুরতে থাকেন তাপস বিশ্বাস। তিনি সিআইডির ঢাকা মেট্রোর এসআই। গত আগস্টের শেষে তাপস সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে এক খামারে সুমির স্বামী রঞ্জু মিয়াকে খুঁজে পান। ওই খামারে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছিলেন রঞ্জু। এ খামার থেকে রঞ্জুকে ১৬ সেপ্টেম্বর সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে গ্রেফতার করে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন আদালতে দুই বছর আগের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তি দেন রঞ্জু। সিআইডি সূত্র জানায়, ঘটনার বর্ণনায় রঞ্জু বলছিলেন, ‘সুমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ২০১৬ সালে সুমির সঙ্গে বিয়ে হয়। তাকে নিয়ে দক্ষিণখান এলাকায় থাকতাম। ২০১৮ সালে ১০ আগস্ট রাত ১১টায় কাজ শেষে বাসায় আসি। খাওয়া-দাওয়া শেষে সুমির সঙ্গে ঘুমাতে যাই। সুমি আমার আগের স্ত্রী নিয়ে ঝগড়া শুরু করে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি শুরু হয়। একপর্যায়ে আমি তার গলা টিপে ধরে রাখি। এতে সুমি তার হাত-পা ছেড়ে দেয় এবং কোনো কথা বলে না। তখন দেখি সে নিশ্বাস নিচ্ছে না। ভয় পেয়ে যাই। নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার গলায় থাকা সোনালি রঙের ওড়না পেঁচিয়ে একটি শক্ত গিঁট দিয়ে রাত সাড়ে ৩টায় বাসা থেকে বের হয়ে যাই। এখানে-সেখানে যেতে থাকি। বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে চলতে থাকি।’ সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জাকির হোসাইন এ প্রতিবেদককে জানান, ক্লু-লেস এই মামলার তদন্তে খুনির অবস্থান পাওয়া যাচ্ছিল না। ছদ্ম বেশে এবং প্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান নিশ্চিত হয়ে খুনিকে গ্রেফতার করতে সম্ভব হন তারা। মামলার এজাহারে সুমির বাবা শামসুল হক অভিযোগ করেন, ‘রঞ্জু দক্ষিণখানের একটি ওয়াশিং ফ্যাক্টরিতে চাকরি করত। সে আমার মেয়েকে প্রায়ই মারধর করত। ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট সকালে সুমি আমাকে ফোনে জানায়, রঞ্জু তাকে ব্যাপক মারধরের পর দুই দিন ধরে তাকে না খাইয়ে রেখেছে। তার পক্ষে ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়।’ তাই তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে সুমি। তখন তিনি মোবাইলের মাধ্যমে তার মেয়ের কাছে ৫০০ টাকা পাঠান। দুই দিন পর বিকালে দক্ষিণখান থানা থেকে তাকে ফোন করে জানানো হয়, ঘরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শক্ত গিঁট দেওয়া অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে সুমির লাশ। পরে ঢাকায় এলে সুমির বাড়ির মালিকসহ আশপাশের লোকজন তাকে জানান, রঞ্জুর খোঁজ না পেয়ে তার অফিস থেকে সজল হালদার নামে এক স্টাফকে বাসায় পাঠানো হয়। সজল বাসায় এসে দরজা বন্ধ দেখে অনেক ডাকাডাকি করেন। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখেন, দরজার হ্যাজবোল লাগানো। পরে সজল দরজার হ্যাজবোল খুলে ভিতরে গিয়ে দেখেন গলায় ওড়না পেঁচানো সুমির লাশ।

সর্বশেষ খবর