বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঢাকার মুঘল স্থাপনা লালবাগ কেল্লা

মোস্তফা মতিহার

ঢাকার মুঘল স্থাপনা লালবাগ কেল্লা

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী ঢাকায় মুঘল শাসনের অনন্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লা বা লালবাগ দুর্গ। এটি নিছক কোনো কেল্লাই না, মুঘল শাসন ও তাদের জৌলুসময় যাপিতজীবনের নীরব সাক্ষী। ইতিহাসের গর্বিত অংশ হয়ে এখনো রাজধানীর বুকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই দুর্গটি। ঢাকার প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে লালবাগ কেল্লা জানান দিচ্ছে ঢাকার ইতিহাসে মুঘল রাজত্বের কথা। মসজিদ, পরীবিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম এই তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয়েই লালবাগ দুর্গ। সঙ্গে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারাসহ একটি পানির নালা তিনটি ভবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে। বিস্তৃত প্রান্তরের ভিন্ন ভিন্ন লনের চারপাশে ফুল আর সুশোভিত বৃক্ষরাজি, সুড়ঙ্গ পথ, দরবার হল, সুরম্য প্রাসাদ, হাম্মামখানা, মসজিদ, উঁচু পাহাড়, রাজকীয় শৌচাগার, পোশাক পরিবর্তন কক্ষ, পোড়ামাটির পাইপ দিয়ে গরম পানি সরবরাহের ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনা, মুঘলদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও যুদ্ধাস্ত্রের সরঞ্জামে পরিপূর্ণ জাদুঘর ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত লালবাগ কেল্লাটি ঢাকার ইতিহাসে এক গৌরবান্বিত অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। মুঘল আমলের অনন্য স্থাপনার ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত অসমাপ্ত মুঘল স্থাপনাটির আরেক নাম কেল্লা আওরঙ্গবাদ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র সম্রাট মুহাম্মদ আজম শাহ ১৬৭৮ সালে এই অসমাপ্ত কেল্লাটির কাজ শুরু করেন। তিনি প্রায় ১৫ মাস বাংলায় ছিলেন। দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। এ সময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। পরবর্তীতে মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ফের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৬৮৪ সালে এখানে শায়েস্তা খাঁর কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানুর (পরীবিবি) মৃত্যু ঘটে। এরপর মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর হওয়ার কারণে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখে ওই বছরই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। লালবাগ কেল্লার প্রধান তিনটি স্থাপনার একটি হলো পরীবিবির সমাধি। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করার পর এটি জনপ্রিয়তা হারায়। রাজকীয় মুঘল আমলের রাজসিক অধ্যায় শেষ হওয়ার পর দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। ১৮৪৪ সালে এলাকাটি ‘আওরঙ্গবাদ’ নাম বদলে ‘লালবাগ’ নাম পায় এবং দুর্গটি পরিণত হয় লালবাগ দুর্গে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সাম্প্রতিক উৎখননে দুর্গের অন্যান্য অবকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ধারণা করা হয়, এর দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিরাট বুরুজ ছিল। আর দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের উত্তরে ছিল কয়েকটি ভবন, আস্তাবল এবং পশ্চিম অংশে জলাধার ও ফোয়ারাসহ একটি সুন্দর ছাদবাগান। আবাসিক অংশটি ছিল দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম-পূর্বে, মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিমে। দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে ৫টি বুরুজ ছিল উচ্চতায় দুই তলার সমান এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল ২টি বুরুজ, যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারে। বুরুজগুলোর একটিতে ছিল ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। সুবেদারদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো কেল্লার হাম্মামখানা এবং দেওয়ান-এ-আম বা দরবার হল ব্যবহৃত হতো কোর্ট বা বিচারালয় হিসেবে। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এখান থেকেই তিনি সব বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। এই ভবনের নিচে রয়েছে কামান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এর একপাশে স্থাপন করা হয়েছে মুজিব কর্নার। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের নানা তথ্য রয়েছে এই কর্নারে। কেল্লার তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পরীবিবির সমাধি। এখানে সমাহিত আছেন সুবেদার শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবিবি। কন্যার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে মার্বেল পাথর ও কষ্টি পাথরের সঙ্গে বিভিন্ন রঙের ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ ৯টি কক্ষের সমন্বয়ে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেন শায়েস্তা খাঁ। পরীবিবির সমাধিস্থলে আটটি ঘর আছে। স্থাপনাটির ছাদ করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরে তৈরি এবং চার কোণে চারটি আটকোণ মিনার ও মাঝে একটি আটকোণা গম্বুজ আছে। মূল সমাধিসৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের ওপরের এই গম্বুজটি একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল। পরবর্তীতে পিতলের/তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটির অভ্যন্তর ভাগ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত। আর পরীবিবির সমাধির বাইরে রয়েছে শায়েস্তা খাঁর একান্ত সহ-সেনা অধিনায়ক খোদাবন্দ বা মির্জা বাঙালির সমাধি। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কেল্লার বিশাল ও সুউচ্চ প্রধান দরজাটি দিয়ে প্রবেশ করলেই সোজা চোখে পড়বে পরীবিবির সমাধি। ১৬৬৮ সালের ৩ মে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সঙ্গে পরীবিবির বিয়ে হয়। তার আসল নাম ইরান দুখত রাহমাত বানু। ১৬৮৪ সালে তার মৃত্যু হয়। এরপর তৎকালীন নির্মাণাধীন লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে তাকে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিস্থলকে চিহ্নিত করে পরীবিবির মাজার নির্মিত হয়। পরীবিবির সমাধির পশ্চিমে রয়েছে শাহী মসজিদ। ১৬৭৮-৭৯ সালে বাংলার সুবেদার থাকাকালীন সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ। বর্তমানেও মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হাম্মামখানা ও দরবার হল সমৃদ্ধ সুবেদার শায়েস্তা খাঁর সুরম্য দ্বিতল প্রাসাদটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাদুঘরের নিচতলায় রয়েছে সৈনিকদের ব্যবহৃত ১৯ শতকের বর্শামূল ও বর্শাফলক, লোহার জালের বর্ম, ছোরা ও খাপ, গুপ্তি, ঢাল, তরবারি, দস্তানা, পারকাশন লক বন্দুক ও রাইফেল, তীর, ধনুক, শিরস্ত্রাণ, বক্ষবর্ম, পারস্যের তৈরি বাসনপত্র, কামানের গুলি তৈরির ছাঁচ, ফ্লিন্ট লক পিস্তল, পারকাশন লক পিস্তল ও সিসার গুলি, সৈনিকের পোশাক, ধাতুর তৈরি সুরার পাত্র, চীনা গামলা, ফারসি ভাষার কিতাব আদব-ই-আলমগীরি, সুরা ইউসুফের তাফসির, আরবি ও ফারসি তাফসির, পবিত্র কোরআন শরিফসহ  মুঘল আমলের আরও নানা দুর্লভ নিদর্শন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হওয়াতে জাদুঘরটির দোতলায় দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মুঘল স্থাপনার অনন্য নিদর্শন ‘লালবাগ কেল্লা’ এখন আর শুধু ঢাকার ঐতিহ্য ও গর্বই নয়, এটি এখন সমগ্র উপমহাদেশের একটি অনন্য ঐতিহ্য ও গর্বও। গর্বিত এই ইতিহাসের অংশ হতে ও এর সৌন্দর্য উপভোগে প্রতিদিনই রাজধানী ও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন লালবাগ কেল্লায়। আর ইতিহাসের অংশকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করে নিজেদের মোবাইল গ্যালারির আর্কাইভকে সমৃদ্ধ করার প্রাণান্তকর চেষ্টাও দেখা যায় তাদের মাঝে। মুঘল এই নিদর্শনের সঙ্গে ইতিহাসের অংশ হতে অনেকে আবার সেলফির উন্মাদনার সাহায্যও নেন। মঙ্গল থেকে শনিবার প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এবং দুুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনীর বিনিময়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকছে লালবাগ কেল্লা। রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ আর সোমবার অর্ধেক কার্যদিবস হিসেবে দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকছে কেল্লা। জনপ্রতি দর্শনী ফি ২০ টাকা, বিদেশি নাগরিকদের জন্য ২০০ টাকা ও সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য দর্শনী ফি ১০০ টাকা। এ ছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি দর্শনী ফি ৫ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর