বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

যত সংকট ক্ষুদ্র ঋণে

সরকারি প্রণোদনা থেকে তেমন সুবিধা পাননি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রণোদনা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছে। সরকার অতিক্ষুদ্র, কুটিরশিল্পকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করে এই খাতের (সিএমএসএমই) জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সুবিধা দিয়েছিল। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, সরকারি প্রণোদনা থেকে তেমন কোনো সুবিধা পাননি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এখন অবিতরণকৃত অর্থ বাণিজ্যিক খাতে (ট্রেডিং) বিতরণ করে দায় মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো যাতে আবার চালু হতে পারে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, সে কারণে সরকারি-বেসরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব নিয়েছিল, তারা ভাগাভাগি করে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে বিতরণ করবে।  কথা ছিল, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সেই প্রণোদনা থেকে এই খাতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা দেবে। এখন ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে সরকারের কাছে যে হিসাবটি এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে- সিএমএসএমই খাতে মাত্র ৩৩৪ কোটি টাকার মতো বিতরণ করেছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো, যেটি লক্ষ্যমাত্রার ১১ শতাংশ মাত্র। এ ছাড়া নি¤œ আয়ের পেশাজীবী কৃষক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম বাবদ ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মাত্র ১ হাজার ৩শ কোটি টাকা বিতরণ করতে পেরেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারিশিল্পকে উজ্জীবিত করতে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের এই হারকে হতাশাব্যঞ্জক বলে উল্লেখ করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম। সম্প্রতি এক সভায় তিনি এই হতাশা ব্যক্ত করে সিএমএসএমই খাতকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণোদনার অর্থ বিতরণের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ঘরে ঘরে গিয়ে প্রণোদনার ঋণ বিতরণের পরামর্শ দেন তিনি। কোথায় সমস্যা : ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনার ঋণ বিতরণের এই ধীরগতির পেছনে অবশ্য নিজেদের দায় দেখছে না ব্যাংকগুলো। প্রণোদনা সঠিকভাবে কার্যকর করতে না পারার পেছনে তারা ৫টি কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- (১) করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক মন্দার আশঙ্কায় ঋণ নিতে আগ্রহী হয় না; (২) ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসএমই খাতের তৃণমূল ও পল্লী পর্যায়ের দ্বারে দ্বারে যাওয়া সম্ভব হয়নি, ফলে সরকারি প্যাকেজ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়নি; (৩) ক্ষুদ্র গ্রাহকদের তথ্যভান্ডার না থাকায় যোগ্য ঋণগ্রহীতা খুঁজে পেতে সমস্যা; (৪) সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে গ্রাহকের জামানত প্রদানে সমস্যা এবং (৫) সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণে ট্রেডিং খাতে কম বরাদ্দ (২০ শতাংশ) দেওয়া। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এসব যুক্তি অবশ্য গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে। ওই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একই অবস্থায় থেকে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো কিন্তু তাদের লক্ষ্যমাত্রার শতকরা প্রায় ৬১ ভাগ প্রণোদনার ঋণ বিতরণ করেছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো পারলে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো কেন পারবে না, এই প্রশ্নটি উঠেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ বিতরণে অনাগ্রহী মূলত জামানত সমস্যার কারণে। বেশিরভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ গ্রহণে প্রয়োজনীয় জামানত দিতে পারে না। অথচ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে সবার আগে ‘জামানত’র বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে অভিজ্ঞতা রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এবং পিকেএসএফ-এর। একই সঙ্গে এ দুটি সংস্থার কাছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তথ্যভান্ডারও রয়েছে। সে কারণে ৮ অক্টোবর যে সভা হয়, ওই সভায় এ দুটি সংস্থাকে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের বিষয়ে সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। এ বিষয়ে এমআরএর নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান অমলেন্দু মুখার্জি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে আমরা বলেছি যে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো চাইলে আমাদের ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআইএন) নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তাদের প্রণোদনা বাস্তবায়ন করতে পারে। যেহেতু অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ঋণ বিতরণে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থাগুলো অভিজ্ঞ এবং তাদের কাছে গ্রাহকদের বিষয়ে তথ্য রয়েছে ফলে ব্যাংকগুলো এসব তথ্য ব্যবহার করতে পারে।

ট্রেডিং খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর মতামত : প্রণোদনার ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণের ২০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল মফস্বল এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ট্রেডিং খাতে ঋণ দিতে। ব্যাংকগুলোর আগ্রহে এই খাতটিতে ঋণের হার বাড়িয়ে প্রণোদনার ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। গত ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, ‘ট্রেডিং ব্যবসায় নিয়োজিত মাঠ পর্যায়ের উদ্যোক্তাগণ ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন কভিডের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সিএমএসএমই খাতে বরাদ্দকৃত প্রণোদনার ৩০ শতাংশ অর্থ ট্রেডিং খাতে বিতরণ করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ ঋণের প্রায় এক- তৃতীয়াংশ এখন চলে যাবে ট্রেডিং খাতে, যে খাতটি এ দেশে এখন ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ হিসেবে পরিচিত।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর