রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাবান্ধা দিয়ে ট্রেন যাবে শিলিগুড়ি

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) থেকে ফিরে

দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা দিয়ে সরাসরি ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এই বন্দর থেকে আরও দুই প্রতিবেশী ভুটান ও নেপালের সঙ্গেও ভবিষ্যতে রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে সরকার। এমন উদ্যোগ নিয়ে তিন দেশের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। পর্যায়ক্রমে চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, শিগগিরই পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতের শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেল যোগাযোগের প্রাথমিক কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের প্রাথমিক কাজ চূড়ান্ত হয়েছে।

সম্প্রতি রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই সরকারের আমলেই পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতের শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করা হবে। এতে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। দিগন্ত প্রসারিত হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের।’

এর আগে বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা থেকে ভারতের শিলিগুড়ি পর্যন্ত ট্রেন চালুর বিষয়ে আলোচনা করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ। ১৫ সেপ্টেম্বর রিভা গাঙ্গুলী দাশ রেলভবনে মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এলে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। আলাপকালে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মিত হলে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ট্রেন চালানো যাবে বলে জানান রেলমন্ত্রী। বাংলাবান্ধা-শিলিগুড়ির পাশাপাশি চিলাহাটি-হলদিবাড়ীর মধ্যে ট্রেন চালুর বিষয়েও ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেন মন্ত্রী। নুরুল ইসলাম সুজন জানান, হলদিবাড়ীতে ভারতের অংশের ১৫০ মিটার নির্মাণ করলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ট্রেন যোগাযোগ চালু করা সম্ভব হবে। এটি যাতে ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা যায় সে বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী ভারতীয় হাইকমিশনারকে অনুরোধ জানান।

জানা যায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটানের দূরত্ব অত্যন্ত কম। এর মধ্যে বাংলাবান্ধা থেকে কয়েকশ গজের মধ্যেই ভারত সীমান্ত। এই স্থলবন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার। ভুটানের দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার এবং চীন সীমান্ত মাত্র ২০০ কিলোমিটার। সম্ভাবনাময় এই বন্দরটি পাঁচটি বন্ধুপ্রতিম দেশকে একই সূত্রে আবদ্ধ করতে পারে। এ কারণে বাংলাবান্ধা হয়ে চারটি দেশের মধ্যে রেলসংযোগ স্থাপন করতে চায় সরকার। শিগগিরই পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা রুটে ৫৭ কিলোমিটার নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মিত হবে বলে সূত্র জানায়।

জানা যায়, বাংলাবান্ধা দিয়ে শিলিগুড়ির সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে একদিকে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, অন্যদিকে উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের লক্ষ্যে সরকার পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হলে বাড়বে ব্যবসার পরিধি, সরকার পাবে বড় ধরনের রাজস্ব, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। এসব সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই মাঠপর্যায়ে রেললাইনের নকশা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সরকার চায় অত্যন্ত দ্রুত শিলিগুড়ির সঙ্গে রেল যোগাযোগের কাজ শুরু করতে। ভারতের সঙ্গে আলোচনা শেষ হলেই রেললাইনের কাজ শুরু হবে। এর পরই নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের কাজ শুরু হবে।

১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। শুরুতে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে শুরু হয় পণ্য আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ পণ্যবাহী ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করে। ফলে স্থলবন্দরে সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের। উন্মোচিত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার। আর সরকার পাচ্ছে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব। বন্দরের ব্যবসায়িক কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বন্দরের সঙ্গে যুক্ত আমদানি রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীসহ লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাবান্ধা হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ট্রেনলাইন চালু হলে শুধু পর্যটকের সংখ্যাই বাড়বে না, বদলে যাবে উত্তরের জনপদ। অর্থনৈতিকভাবে পঞ্চগড় আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটানের দূরত্ব অত্যন্ত কম। এই তিন দেশের পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্য বাংলাবান্ধা থেকে খুব কাছে। রয়েছে হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গ। রয়েছে দার্জিলিং, কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অন্যান্য স্থানে হাজারো পর্যটন কেন্দ্র। এসব পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণের জন্য বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কভিড-১৯ আক্রমণের আগে প্রতিদিনই হাজার হাজার যাত্রী এই ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে তিন দেশে ভ্রমণ করত। অন্যদিকে এই তিন দেশেই বাংলাদেশি নানা পণ্য রপ্তানি হচ্ছে এ বন্দর দিয়ে। হচ্ছে আমদানিও। তাই ব্যবসায়ীদেরও নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। ভারত ছাড়া অন্য দুই দেশে গমন করতে হলে ব্যবহার করতে হয় শিলিগুড়ি ট্রানজিট। তাই শিলিগুড়ি হচ্ছে মধ্য পথ। এসব দিক বিবেচনা করেই সরকার শিলিগুড়ির সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের কথা ভাবছে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আমদানিকারক মোখলেছুর রহমান জানান, শিলিগুড়ির সঙ্গে রেল যোগাযোগ শুরু হলে অনেকগুলো দরজা খুলে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন সহজ হবে, তেমনি রাজস্ব আয়ও বাড়বে। পর্যটকরা অত্যন্ত সহজে ভ্রমণ করতে পারবেন। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। অসুস্থ মানুষের জন্য যাতায়াত খুব সহজ হবে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা বলেন, কানেকটিভিটির দিক দিয়ে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের মতো অন্য কোনো বন্দর নেই। এই বন্দর দিয়ে ভারতের যে কোনো প্রদেশে গমন করা সহজ। শিলিগুড়িতে রয়েছে বিমানবন্দর, আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল, রেলস্টেশন। নেপাল ও ভুটান থেকে অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়তে আসে। তাদের জন্যও রেল যোগাযোগ নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে নেপাল ও ভুটান যাওয়ার পথও রয়েছে শিলিগুড়ির ওপর দিয়ে। তাই পর্যটকদের আগ্রহ যেমন শিলিগুড়ি, তেমনি যোগাযোগের মধ্য স্থান হিসেবে ব্যবসায়ীদের শিলিগুড়ির প্রতি রয়েছে আলাদা আগ্রহ।

সর্বশেষ খবর