সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় দূষিত ঢাকা

মৃতপ্রায় অধিকাংশ খাল । স্কুলের পাশে ভাগাড় । লাখ লাখ দোকানের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে রাস্তায়

গোলাম রাব্বানী ও শামীম আহমেদ

বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় দূষিত ঢাকা

বাবুবাজার ব্রিজের নিচে যেন ময়লার ভাগাড় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুরো রাজধানী যেন বর্জ্যরে ভাগাড়। রেললাইন, সড়ক, খাল, বিল, নদী সর্বত্র ফেলা হচ্ছে কঠিন ও তরল বর্জ্য। বর্জ্যরে বড় অংশই অপচনশীল পলিথিন। এতে ভরাট হচ্ছে খাল-নদী-জলাশয়। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিক্রির উপযোগী না হলে ময়লাশ্রমিকরাও নিচ্ছেন না বড় মালামাল। ফলে পুরনো জাজিম, লেপ-তোশক, আসবাবের মতো জিনিসপত্রও ফেলা হচ্ছে খালে। এতে মৃতপ্রায় রাজধানীর অধিকাংশ খাল। বিভিন্ন স্কুলের পাশেই গড়ে উঠেছে বর্জ্যরে ভাগাড়। নগরজুড়ে গড়ে ওঠা লাখ লাখ ছোট দোকানের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে রাস্তায় বা রাস্তার পাশে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে তা সর্বত্র। নগরীর পরিচ্ছন্নকর্মীরা ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাট ঝাড়– দিতে নামলেও প্রতিদিন তৈরি হওয়া বর্জ্যরে অর্ধেকই সংগ্রহ করতে পারছে না সিটি করপোরেশন। এতে বর্জ্যমুক্ত পরিচ্ছন্ন ও সবুজ রাজধানীর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে।

শুধু দোকান, রেস্তোরাঁ বা বাসাবাড়ির বর্জ্যই নয়, বর্জ্য ফেলার সুব্যবস্থা না থাকা ও সচেতনতার অভাবে নগরবাসীর হাত থেকেও প্রতিনিয়ত সড়কে, খালে, নালা-নর্দমায় পড়ছে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে দৈনিক ছয় থেকে সাত হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭০ টন গৃহস্থালি, ১ হাজার ৯৮৩ টন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এবং ১ হাজার ৫৫৫ টন সড়ক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্যরে বড় একটি অংশই সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে না। প্রতিদিন রাস্তায় উৎপাদিত প্রায় ১ হাজার ৫৫ টন বর্জ্য সংগ্রহ করতে দুই সিটি মিনি ডাস্টবিন বসালেও তা কোনো কাজে আসেনি। নাগরিক সচেতনতার অভাব, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি ও দূষণ রোধে কঠোর আইন না থাকায় আশা জাগানিয়া কাজটি আলোর মুখ দেখেনি। জানা গেছে, ২০১৬ সালে দুই সিটির সড়কগুলোতে বসানো হয় প্রায় ১১ হাজার মিনি ডাস্টবিন। সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে এসব বিনের অধিকাংশ উধাও। আসাদ গেট থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত ৯০টি বিনের বেশিরভাগই নেই। মিরপুরে কিছু বিনের লোহার দ- দাঁড়িয়ে থাকলেও বিন নেই। হাতিরঝিলে কিছু বিন উপচে পড়ছে আবর্জনায়, পরিষ্কার করার নাম নেই। কিছু বিন খালি পড়ে থাকলেও ঝিলপাড়ের সর্বত্র পড়ে আছে চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল, বাদামের প্যাকেট। শাহজাদপুর ঝিলপাড় থেকে গুদারাঘাট হয়ে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত ঝিলপাড়ের অধিকাংশ বাড়ি ও দোকানের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে হাতিরঝিলে। কয়েক স্থানে ঝিলের মধ্যে ৩০ ফুট পর্যন্ত চর তৈরি হয়েছে বর্জ্যরে কারণে। অথচ এই সড়কেই রয়েছে ডিএনসিসির বর্জ্য ফেলার এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন)। জিপিও এবং বায়তুল মোকাররম মার্কেটের মাঝের সড়কটির পুরানা পল্টন প্রান্তে রাস্তার ওপরই রাখা হচ্ছে মার্কেটের সব আবর্জনা। দুর্গন্ধে পথচারীরা নাক চেপে পার হন স্থানটি। সিটি করপোরেশন রাস্তাটি নিয়মিত পরিষ্কার করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যাগ, কাগজসহ বিভিন্ন আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যায় সড়কটি। ফুটপাথের দোকানদাররা নিজেদের দোকানের সামনের অংশ পরিষ্কার রাখলেও দোকানের তৈরি বর্জ্য ঝাড়– দিলে ফেলছেন মূল সড়কে। এদিকে হাতের নাগালে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থাকার পরও কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিং এলাকার সব ভ্রাম্যমাণ দোকানের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে রেললাইনের পাশে। গতকাল এক ডাব বিক্রেতা বলেন, কয়েক মাস আগে এসটিএসে ময়লা ফেলতে গেলে টাকা চেয়েছিল। তার ওপরে দুর্গন্ধ। এ জন্য রেললাইনের পাশেই বর্জ্য ফেলেন। দুই সিটির কয়েকটি নতুন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে বর্জ্য ফেলার কোনো ব্যবস্থাই নেই। সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে আশপাশের জলাশয়, নিচু জমি ও সড়কের পাশে। বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে, খালে ও জলাশয়ে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণার তথ্য বলছে, বুড়িগঙ্গা নদীর ২৩৭টি পয়েন্ট দিয়ে, তুরাগের ৮৪টি পয়েন্ট দিয়ে, বালু নদীর ৩২টি পয়েন্ট দিয়ে এবং টঙ্গী খালের ৪৭টি পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। রাজধানীর ২৬টি খাল বর্জ্যরে কারণে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও-বাসাবো খালে গিয়ে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি, দোকান ও বাজারের বর্জ্য ফেলে নর্দমায় পরিণত করা হয়েছে খালটিকে। স্থানীয়রা জানান, সিটি করপোরেশনের ভ্যান অস্থায়ী বাজারের বর্জ্য নিতে আসে না। এ ছাড়া পাশে খাল থাকায় অনেক বাসিন্দা ও দোকানদার বর্জ্য ফেলতে টাকা খরচ করতে চান না। খালে বর্জ্য ফেললে কেউ নিষেধও করে না। এ কারণেই খালটির এই দুর্দশা। গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ বিশিলে গোদাখালী খাল পরিষ্কার করতে গিয়ে জাজিম, পুরনো সোফা, টেলিভিশনের খোলস, ভাঙা ফ্রিজ, টায়ারসহ অনেক ভারী বর্জ্য পায় উত্তর সিটি করপোরেশন। এ ব্যাপারে খালপাড়ের বাসিন্দারা জানান, বিক্রির উপযোগী না হলে বড় বড় মালামাল ময়লাশ্রমিকরা নিতে চান না। এ কারণেই সবাই খালে এগুলো ফেলছে। মীরপুর-আগারগাঁও ৬০ ফুট রাস্তার ৪-৫ জায়গায় ময়লার ভাগাড়। মনিপুর স্কুলের পাশেই ফুটপাথ ও আইল্যান্ডের ওপর স্তূপাকারে পড়ে আছে বর্জ্য। একই অবস্থা এই সড়কের পীরেরবাগ এলাকায়। মিরপুর-১০ থেকে মিরপুর-১৪ নম্বর যাওয়ার পথে ন্যাম ভবনের বিপরীত পাশে বর্জ্যরে স্তূপ। পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের বিপরীতে রাস্তার পাশে বর্জ্য ফেলার নির্ধারিত জায়গা থাকলেও ওই রাস্তায় ৩-৪ স্থানে দিনে-রাতে নিয়মিত বর্জ্য ফেলছে আশপাশের লোকজন। মিরপুর মাজার রোডে একটি এসটিএস থাকলেও কাঁচাবাজার ও আড়তের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে মূল সড়কে। আগারগাঁও সমবায় মোড়ে কল্যাণপুর খালটি বর্জ্যে ভরে গেছে। বর্জ্যরে ওপর জন্মেছে ঘাস। এই খালের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাজার ও দোকানের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে খালে। গাবতলী ব্রিজ থেকে বেড়িবাঁধ সড়কটির পাশে সর্বত্র বর্জ্যরে স্তূপ। নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বেশি বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বেশি আর্থিক সুবিধা দিলে ময়লাশ্রমিকরা নিজ উদ্যোগেই বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করবে। কিন্তু তারা খুবই কম মজুরি পান। সিঙ্গাপুরের রাস্তায় কাগজ বা ময়লা ফেললে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। বাংলাদেশিরা সিঙ্গাপুরে গেলে ঠিকই সেই আইন মেনে চলেন। দেশে মানেন না। এ জন্য এখানেও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে অবশ্যই বর্জ্য ফেলার সুব্যবস্থা করতে হবে। এখানে রাস্তায় বিন বসালে চুরি হয়ে যায়। আশপাশের কাউকে সেটি দেখভালের দায়িত্ব দিলে এমনটা হতো না। দেখভালের জন্য ওই ব্যক্তির কর মওকুফ করতে পারে সিটি করপোরেশন। রাস্তার দোকানগুলোকে তার আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখতে বাধ্য করা যায়। ময়লা হলে জরিমানা করবে। তাহলে সে নিজেও বর্জ্য ফেলবে না, অন্যকেও ফেলতে দেবে না। প্রচুর প্লাস্টিকের কারণে বর্জ্য কম্পোস্টিং করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য জৈব ও অজৈব বর্জ্যরে জন্য আলাদা পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার ভালো দাম দিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য কিনে নিতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে বর্জ্যও একটা সম্পদ। এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বলেন, মানুষ সচেতন না হলে দুই কোটি জনসংখ্যার শহরকে বর্জ্যমুক্ত রাখা কঠিন। এ জন্য আমরা কাউন্সিলরদের মাধ্যমে নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। মাইকিং, প্রচারপত্র বিলি করছি। কোনো কিছুতেই কাজ না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যত্রতত্র ময়লা ফেললে আমাদেরও জরিমানার বিধান আছে। পুলিশ ইচ্ছা করলে সিটি করপোরেশন আইনে মামলা দিতে পারে। এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের সীমিত জনবল দিয়ে এটা দেখা কঠিন। সড়কে লোহার বিন বসালে চুরি হয়ে যায়। এ জন্য বিক্রি অযোগ্য বিন স্থাপনের চিন্তা করছি। সবাই সচেতন হলেই শহরকে পরিষ্কার রাখা সম্ভব। ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান বলেন, নিজের জায়গা নিজে নোংরা করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে মেয়র মহোদয় খালগুলো পরিষ্কারে হাত দিয়েছেন। খালে যেসব বর্জ্য মিলছে তা অকল্পনীয়। আমরা সচেতন করার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর