সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিকল্প পরিবহন জ্বালানি অটোগ্যাসের চাহিদা বাড়ছে

শিমুল মাহমুদ

ঢাকা-কক্সবাজার মহাসড়কের আমিরাবাদ এলাকায় সড়কসংলগ্ন আদুনগর পেট্রলপাম্প। রাত ৯টার দিকে একের পর এক থ্রি-হুইলার এসে ভিড় করে এই পাম্পে। এই সময়টায় হাইওয়েতে যানবাহনের চাপ কিছুটা কম থাকে। এই সুযোগে মহাসড়ক ডিঙিয়ে অটোগ্যাস নিতে আসে থ্রি-হুইলারগুলো। সম্প্রতি এই পাম্পে গ্যাস নিতে আসা থ্রি-হুইলার চালক জসিম উদ্দিন বলেন, একবার গ্যাস নিলে সারা দিন চলে যায়। খরচও অনেক কম। এজন্য অনেক দূর থেকে এলপি গ্যাস নিতে আসি।  পরিবহন জ্বালানিতে পেট্রল, ডিজেলের চাহিদা ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এখন সিএনজির জায়গা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজি বা অটোগ্যাস। সিএনজিচালিত যানবাহনগুলো অটোগ্যাসে রূপান্তর করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সারা দেশে হাজার হাজার বাণিজ্যিক যানবাহন অটোগ্যাসে চলছে। বিদ্যমান পেট্রলপাম্পে অটোগ্যাস ফিলিং সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। দেশের এলপিজি খাতের বড় উদ্যোক্তারা গৃহস্থালি এলপিজির পাশাপাশি অটোগ্যাসে বিনিয়োগ শুরু করেছে। শীর্ষ এলপিজি উৎপাদক বসুন্ধরা গ্রুপ এককভাবে সারা দেশে চার শতাধিক অটোগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা সরকারি তিনটি তেল  কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে। অটোগ্যাস খাতে বিনিয়োগের দৌড়ে আরও রয়েছে বেক্সিমকো, ওমেরা, এনার্জিপ্যাকসহ বিভিন্ন কোম্পানি। সরকারিভাবে ইতিমধ্যে প্রায় দেড় হাজার এলপিজি স্টেশন স্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো। অটোগ্যাস বা এলপিজি ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রশংসিত। বাংলাদেশেও আগামী দিনের জ্বালানি হিসেবে এলপিজির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এখন সরকারিভাবেই জোর দেওয়া হচ্ছে পরিবহন খাত এলপিজিতে রূপান্তর হোক। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘনীভূত প্রাকৃতিক গ্যাস-সিএনজির স্থলে ব্যাপকভাবে এলপিজি চালু হলে দেশীয় গ্যাসের ওপর চাপ কমবে। অন্যদিকে পাইপলাইনের নির্ভরতা না থাকায় এলপিজি দ্রুত সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়বে। ফলে যানবাহনে এলপিজির বিস্তারে জ্বালানি তেল আমদানির ওপরও চাপ কমবে। এজন্য যারা এলপিজি বা অটোগ্যাস স্টেশন করতে চান সরকার তাদের উৎসাহিত করছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩০টির বেশি এলপিজি স্টেশন স্থাপিত হয়ে গেছে। এলপিজি ফিলিং স্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, থ্রি-হুইলারসহ মিড রেঞ্জের প্রায় ৪০ হাজার গাড়ি এখন এলপিজিতে চলছে। এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ অটো এলপিজি স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল হাসিন পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে অটোগ্যাসের সম্ভাবনা প্রচুর। সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য জ্বালানি হিসেবে সারা দেশে এলপিজির চাহিদা বাড়ছে। এর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি কম। সব মিলিয়ে দেশের জ্বালানি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে অটোগ্যাস। মানুষের মধ্যেও অটোগ্যাসের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। গাড়িতে অটোগ্যাস ব্যবহারে সরকারকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে সিএনজি ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত। একটি সিএনজি স্টেশন করতে মেশিনারিজসহ আড়াই-তিন কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ একটি এলপিজি স্টেশন করা যাচ্ছে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে। একটি সিএনজি স্টেশন করার খরচে ১০টি এলপিজি স্টেশন করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, এলপি গ্যাসে এখন বিপুল সংখ্যায় থ্রি-হুইলার চলছে। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে সিএনজি সুবিধা সীমিত সেখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অটোগ্যাস। পরিবহন খাতে অটোগ্যাসের অন্তর্ভুক্তি আগামী দিনে যানবাহনের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে ডিজেল, অকটেন এমনকি বর্তমানের বহুল ব্যবহৃত সিএনজির চাহিদা সীমিত হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, দেশে গাড়িতে ২০০৫ সালের দিকে অটোগ্যাসের ব্যবহার শুরু হলেও দীর্ঘদিন এটি মনোযোগের আড়ালে ছিল। মূল্য সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সরকারও অটোগ্যাসকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। ২০১৫ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় সিএনজি স্টেশনের অনুমোদন। সিএনজির দামও বাড়ানো হয় দফায় দফায়। ফলে এলপিজির দিকে ঝুঁকতে থাকেন যানবাহন মালিকরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহকারী বড় উদ্যোক্তারা এখন অটোগ্যাসের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, বিএম, পেট্রোম্যাক্স, এনার্জিপ্যাকের মতো দেশের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ইতিমধ্যে প্রায় দেড় হাজার অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীরা জানান, ১৫০০ সিসির একটি গাড়ির সিলিন্ডারে অটোগ্যাস ধারণক্ষমতা ৬০ লিটার। একবার ফুল রিচার্জে একটি গাড়ি হাইওয়েতে ৪০০-৪৫০ কিলোমিটার চলতে পারে। বিপরীতে সমপরিমাণের এক সিলিন্ডার সিএনজিতে একটি গাড়ি চলতে পারে ৮০-৯০ কিলোমিটার। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৪৩ টাকা। আর ১ লিটার অটোগ্যাসের বাজারমূল্য ৫০ টাকা। সে হিসাবে সিএনজির তুলনায় অটোগ্যাস অনেক সাশ্রয়ী। এই সাশ্রয়ের নিরিখে সারা দেশে হাজার হাজার থ্রি-হুইলার অটোগ্যাসে কনভার্ট করা হয়েছে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তব কারণেই সিএনজির সহজপ্রাপ্যতা সীমিত করা হচ্ছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনের অনুমোদন বন্ধ, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে চাপে রাখা হয়েছে সিএনজিচালিত যানবাহনের ব্যবহারকারীদের। এই প্রেক্ষাপটে দেশে অটোগ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। ক্লিন ফুয়েল বা গ্রিন ফুয়েল হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে এ গ্যাসের। অটোগ্যাস উন্নত দেশগুলোয় গাড়ির প্রধান জ্বালানি। সরকারি নীতি সহায়তা নিয়মিত পাওয়া গেলে অটোগ্যাসও পরিবহন খাতে দেশের প্রধান জ্বালানি হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে মনে করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।

সর্বশেষ খবর