শিরোনাম
বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসী হামলায় সতর্কতা ইউরোপে

ভিয়েনায় গুলিতে নিহত ৩, ফ্রান্সে চার্চের সামনে যাজককে গুলি দুই মুসলিম নারীকে ছুরিকাঘাত, নিস শহরে তিনজন হত্যা

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

সন্ত্রাসী হামলায় সতর্কতা ইউরোপে

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ২ নভেম্বর সোমবার রাতে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। গুলিতে তিন ব্যক্তি নিহত হন, এর মধ্যে এক বন্দুকধারীও রয়েছেন। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে বন্দুকধারীরা ভিয়েনার কেন্দ্রস্থলের ছয়টি স্থানে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। এতে দুই ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন বেশ কয়েকজন। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্তিয়ান কুর্জ এ ঘটনাকে ‘ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, পুলিশ এক হামলাকারীকে খুঁজছে। ভিয়েনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ইহুদিদের উপাসনালয় সিনাগগের কাছেও গুলির ঘটনা ঘটে। তবে এ সময় সিনাগগ বন্ধ ছিল। পুলিশ জানায়, গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ গেছে একজনের। আরেকজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে। ১৪ ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি। তার মধ্যে ছয়জনের অবস্থা গুরুতর। আহতের মধ্যে পুলিশের এক কর্মকর্তাও রয়েছেন। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে অস্ট্রিয়াজুড়ে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের কয়েক ঘণ্টা আগে গুলির এ ঘটনাগুলো ঘটল। এ সময় অনেক মানুষ বাইরে ছিল। ঠিক কতজন হামলাকারী এ হামলায় অংশ নিয়েছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অস্ট্রিয়ার গণমাধ্যম বলছে, এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইউরোপীয় নেতারা গুলির এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানিয়েছেন, ভয়ানক এ হামলার ঘটনায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত।

যাজককে গুলি : ফ্রান্সের লিওঁ শহরে গ্রিসের এক ধর্মযাজককে গুলি করা হলে তিনি মারাত্মক আহত হন। গত শনিবার লিওঁ শহরের চার্চে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। বিবিসি জানায়, গুলি করার পর বন্দুকধারী পালিয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজন একজনকে আটক করে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এ হামলার উদ্দেশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। কর্তৃপক্ষ ঘটনাটির তদন্ত শুরু করেছেন। ফ্রান্সের নিস শহরের চার্চে ছুরিকাঘাতে তিনজনকে হত্যার পর এবার লিওঁ শহরে হামলার ঘটনা ঘটল। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এটিকে সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করেন। ঘটনাস্থলে কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয় সময় বিকাল ৪টার দিকে ধর্মযাজকের ওপর হামলার ঘটনাটি ঘটে। ওই সময় চার্চ বন্ধ করছিলেন তিনি। পুলিশ বলছে, হামলাকারীর কাছে শটগান ছিল। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা ও জরুরি সেবাকাজে নিয়োজিত কর্মীরা গেছেন। সাধারণ মানুষকে ওই এলাকায় না যেতে বলা হয়েছে। লিওঁর সরকারি কৌঁসুলি নিকোলাস জ্যাকে এক বিবৃতিতে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার সঙ্গে মিল রয়েছে এমন একজন সন্দেহভাজনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তবে আটক করার সময় তার কাছে অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তার পরিচয় বের করার চেষ্টা চলছে। লিওঁর মেয়র গ্রেগো ডুসে বলেন, ‘আমরা হামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনো কিছু জানি না।’ আহত ধর্মযাজকের নাম নিকোলাস কাকাভেলাকিস। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা গুরুতর। তার পেটে দুবার গুলি করা হয়েছে।

হামলাকারী তিউনিসিয়া-আগত : ফ্রান্সের নিস শহরের একটি গির্জায় ঢুকে ছুরিকাঘাতে তিনজনের হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হামলাকারী কয়েক দিন আগে তিউনিসিয়া থেকে এসেছিলেন। ফ্রান্সের সরকারি কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছেন। ৩০ অক্টোবর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ২১ বছর বয়সী ওই তরুণ অভিবাসীদের নৌকায় করে গত মাসে ইতালির লামপেদুসা দ্বীপে পৌঁছান। আর সেখান থেকে আসেন ফ্রান্সে। তার কাছে ইতালিয়ান রেড ক্রসের নথি ছিল। পুলিশের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। ফরাসি পুলিশের সূত্রগুলো বলছেন, হামলাকারীর নাম ব্রাহিম আউইসাউই। স্থানীয় পুলিশ বলছে, নিস শহরের নটর ডেম বাসিলিকায় বৃহস্পতিবারের ওই হামলায় এক নারীসহ তিনজন নিহত হন। তার মধ্যে ওই নারীকে শিরন্ডেদ করা হয়। হামলার পরপরই সন্দেহভাজন হামলাকারীকে আটক করেছে পুলিশ। হামলার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এ সময় তিনি বলেন, সরকারি ভবনগুলো রক্ষায় শত শত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কৌঁসুলিরা এ হামলা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন। ফ্রান্স পুরো দেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। এর আগে নিসের মেয়র ক্রিশ্চিয়ান এস্ত্রোজি বলেন, এটা সন্ত্রাসী হামলা। ফ্রান্সের সন্ত্রাসবিরোধী প্রধান কৌঁসুলি জেন ফ্রান ও রিকার্দো বলেছেন, হামলাকারীর কাছ থেকে পবিত্র কোরআন, দুটি মোবাইল, ১২ ইঞ্চির একটি ছুরি পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, হামলাকারীর ফেলে যাওয়া একটি ব্যাগ পাওয়া গেছে হামলার স্থলে। ব্যাগের পাশেই দুটি ছুরি পড়ে ছিল যেগুলো হামলায় ব্যবহার করা হয়নি।

নিস শহরের গির্জা নটর ডেম বাসিলিকার কেন্দ্রস্থলে ছুরি নিয়ে হামলায় নিহত তিনজনের একজন বাসিলিকার তত্ত্বাবধায়ক। এ ঘটনায় আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে আহতের সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। এ ঘটনার পর ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্থানীয় জনসাধারণকে হামলাস্থল এড়িয়ে চলতে বলেছে। এ ঘটনায় ওই মন্ত্রণালয়ের জরুরি সভা ডাকা হয়েছে।

১৬ অক্টোবর প্যারিসের শহরতলিতে এক শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিহত ওই শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন। ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ক্লাসে তিনি শিক্ষার্থীদের মহানবী (সা.)-এর কার্টুন দেখিয়েছিলেন। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কার্টুন দেখানোর আগে ওই শিক্ষক ক্লাসে বলেছিলেন, ক্লাসে থাকা মুসলিম শিক্ষার্থীদের যদি খারাপ লাগে, তবে তারা বেরিয়ে যেতে পারে। এ ঘটনাকে ঘিরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মন্তব্য নিয়ে মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের নিচে গত রবিবার জাতিবিদ্বেষী এক হামলায় ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছেন দুই মুসলিম নারী। এ ঘটনায় দুই শ্বেতাঙ্গ নারীকে হত্যাচেষ্টার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। হামলার সময় তাদের চিৎকার করে ‘নোংরা আরব’ বলতে শোনা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও সিটি প্রসিকিউটরের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে দ্য মেট্রো। ফ্রান্সে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। তাদের অভিযোগ, সম্প্রতি দেশটির সরকার মসজিদ ও মুসলিম সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এতে সেখানে ইসলামভীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তদন্তকারী সূত্রের বরাত দিয়ে মেট্রো জানায়, হামলার ভুক্তভোগীরা আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক। তাদের নাম যথাক্রমে কেনজা (৪৯) ও তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট আমেল। তাদের মধ্যে কেনজাকে ছয়বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। হামলায় তার ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে আমেলের হাতে সার্জারি করতে হয়েছে। হামলার পর এ ঘটনায় তৎক্ষণাৎ কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। হামলার কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাটি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে রবিবার রাতে হওয়া ওই হামলার সময় ভুক্তভোগীদের আর্তনাদ ও চিৎকার শোনা গেছে। তবে হামলার দুই দিন পরও অবধি ঘটনাটি নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি প্যারিস পুলিশ। অবশেষে গতকাল এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ১৮ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে একটি জরুরি কল পাওয়ার পর ছুরিকাঘাতের শিকার হওয়া দুই নারীকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন বুধবার প্যারিস প্রসিকিউটরের কার্যালয় জানায়, হামলাটি ঘিরে একটি হত্যাচেষ্টার তদন্ত শুরু হয়েছে। হামলার শিকার হওয়া কেনজা বলেন, ‘আমরা পুরো পরিবার, পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক ও চার শিশু মিলে বাইরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। আইফেল টাওয়ারের এক জায়গায় একটি ছোট ও কিছুটা অন্ধকার পার্ক রয়েছে। আমরা সেখানে যাই। হাঁটার এক পর্যায়ে দুটি কুকুর আমাদের দিকে আসছিল। এতে শিশুরা ভয় পেয়ে যায়। আমার চাচাতো বোন কুকুরগুলোর মালিক দুই নারীকে অনুরোধ করেছিল যে, সম্ভব হলে তারা যেন কুকুরগুলোকে তাদের সঙ্গে রাখে। কারণ, এতে শিশুরা ভয় পাচ্ছে।’ কেনজা আরও জানান, কিন্তু ওই দুই নারী তাদের অনুরোধ শোনেননি। এতে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বাগ্বিতন্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তাদের বিভিন্ন বর্ণবাদী ভাষায় অপমান করেন ওই দুই নারী। আর তারপর তাদের একজন ছুরি বের করে কেনজা ও আমেলকে ছুরিকাঘাত করেন। কেনজা বলেন, ‘তাদের একজন আমাকে মাথায়, পাঁজরে ও হাতে আঘাত করেন। এরপর আমার বোনের ওপর হামলা চালান।’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় হামলাকারীদের ‘নোংরা আরব’ ও ‘নিজ দেশে ফিরে যাও’ বলতে শোনা গেছে। এ ছাড়া অন্যদের মুখে ‘জরুরি সেবায় ফোন দিন, তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে’ ও ‘ছেড়ে দাও, দানব!’ বলতেও শোনা গেছে। পুলিশ আসা পর্যন্ত দুজন স্থানীয় দোকানদার একজন হামলাকারীকে পরাস্ত করে আটকে রাখেন।

সর্বশেষ খবর