শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাস নৈরাজ্যেই রাজধানীর যানজট

ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমেছে যানবাহনের গতি, বছরে নষ্ট ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা, আর্থিক ক্ষতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা, অপচয় মূল্যবান জ্বালানির, ফ্রাঞ্চাইজি গঠন নিয়ে বৈঠক ১০ নভেম্বর

শামীম আহমেদ

বাস নৈরাজ্যেই রাজধানীর যানজট

রাজধানীতে যত্রতত্র বাস থামিয়ে তোলা হচ্ছে যাত্রী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

৫ নভেম্বর বেলা পৌনে ১১টা। রাজধানীর নর্দা এলাকায় আঁকাবাঁকাভাবে দাঁড়িয়ে রামপুরামুখী সড়কটি পুরোপুরি আটকে যাত্রী খুঁজছে দুটি তুরাগ পরিবহন, একটি আকাশ ও একটি ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাস। পেছন থেকে হর্ন দিয়ে বাতাস ভারি করে তুলছে আরও ৬-৭টি বাস, ১৫-২০টি প্রাইভেটকার, ১০-১২টি মোটরসাইকেল ও বেশ কয়েকটি অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন। দীর্ঘসময় রাস্তা আটকে রাখার পর ঠোকাঠুকি করতে করতে চলতে শুরু করে বাসগুলো। ফাঁক পেয়ে পেছনে আটকা পড়া অনাবিল পরিবহনের একটি বাস ডান লেন দিয়ে টান দিয়ে সামনে গিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর ফের চলতে শুরু করে। নতুনবাজারে গিয়ে আবার রাস্তা আটকে দাঁড়ায় বাসগুলো। রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত অন্তত ১১টি স্থানে যাত্রী তোলার জন্য রাস্তার সব লেন আটকে যানজট সৃষ্টি করে বাসগুলো। রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত যেতে যেতে সড়কে জমে যায় শতাধিক গাড়ি। বিপদে পড়ে যানজটে আটকা পড়ে শত শত মানুষ।

সরেজমিন নর্দায় বাসগুলোর এমন ঠোকাঠুকি দেখার পর তুরাগ পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-২১৫৮) একটি বাসে উঠে রামপুরা পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, ১১টি স্থানে বাসটি রাস্তার বিভিন্ন লেনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করে। কোথাও কোথাও এক-দেড় মিনিট রাস্তা আটকে যাত্রী ডাকতে থাকেন বাসের কন্ডাক্টর। নতুন বাজার এলাকায় রাস্তা আটকে যাত্রী তুলতে দেখা যায় অছিম, অনাবিল, ভিক্টর ক্লাসিক, রাইদা, আকাশ, রইস পরিবহনের কয়েকটি বাসকে। এর মধ্যে কোথাও কোথাও যাত্রী দেখে হঠাৎ ডান লেন থেকে দ্রুত গতিতে বাম লেনে, আবার অন্য বাসের পথ আটকাতে বাম লেন থেকে দ্রুত ডান লেনে চলে যেতে দেখা যায় বাসগুলোকে। নর্দা থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ৪৮ মিনিট। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘দ্য ফিউচার প্লানিং অব আর্বান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে উত্থাপিত গবেষণাপত্রে বলা হয়, ঢাকায় যানবাহনের গতি হাঁটার গতির মতো ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। যানজটের কারণে  দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এদিকে রাজধানীতে বাসের নৈরাজ্য বন্ধ করে যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজি গঠনে জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এতে বাস ড্রাইভারদের বাড়তি আয়ের জন্য রেষারেষি করতে হবে না। মাস শেষে তাদের নির্ধারিত বেতন নিশ্চিত থাকবে। এ ব্যাপারে উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক উদ্যোগ নিলেও তার মৃত্যুর পর তা থেমে যায়। দুই সিটির মেয়র নতুন করে কাজটি শুরু করেছেন। এ নিয়ে গত ৬ অক্টোবর নগর ভবনে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ কমিটির এক সভা হয়। সভায় দুই সিটির মেয়র, ট্রাফিক বিভাগ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাস মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে দক্ষিণের মেয়র তাপস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘‘বাস রুট রেশনালাইজেশন ও টার্মিনাল নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিবেদন হাতে পেলে আগামী সভা থেকে কাজ শুরু হবে।’’ আগামী ১০ নভেম্বর সেই সভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে সড়কে ৮০ ভাগ যানজটের জন্য বাসের স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করে উবার চালক বেল্লাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘‘বাস ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন এভাবে রাস্তা আটকে যাত্রী তোলে না। মূল সড়কে রিকশার কারণেও যানজট হয়। রিকশার পেছনে পেছনে চলতে হয় প্রাইভেটকারকে। হর্ন দিলেও সাইড দেয় না। আমরা রাস্তার পাশে পার্কিং করলে, সিটবেল্ট না বাঁধলে মামলা খেতে হয়। বাসগুলো পুরো রাস্তা বন্ধ করে শত শত গাড়ি আটকে দিলেও কিছু বলতে দেখি না।’’ একই অভিযোগ সিএনজি অটোকিশার চালকদের। হাশেম নামের এক সিএনজি অটোরিকশা চালক বলেন, করোনার কারণে যতদিন বাস বন্ধ ছিল ততদিন দিনে ২৫০-৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অটোরিকশা চালিয়েছেন। বাস চালু হওয়ার পর সারা দিনে ১০০ কিলোমিটারও চালাতে পারেন না। যানজটে আটকা থেকে গ্যাস পোড়াতে হয়। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার (ঢাকা দক্ষিণ) বাসুদেব বণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা মামলা দিচ্ছি। জরিমানা করছি। বিআরটিএ মোবাইল কোর্ট বসাচ্ছে। তার পরও বাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সব জায়গায় তো পুলিশ চেকপোস্ট নেই। চালকরা পুলিশ দেখলে ঠিকভাবে চালায়, সামনে গিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা চেষ্টার কমতি রাখছে না। এ ব্যাপারে বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও এনা ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন হলে স্থায়ী সমাধান হবে। এক কোম্পানির অধীন সব গাড়ি আসবে। আলাদা ব্যক্তিমালিকানায় গাড়ি থাকবে না। এখন কোম্পানির নাম একটা, গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন মালিকের। কিছু গাড়ি চুক্তিভিত্তিক চলছে। এগুলোই বেশি প্রতিযোগিতা করে। উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগে বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। উনার মৃত্যুর পর থেমে যায়। পরে দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় ১০ সদস্যের কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি ১১টি মিটিংও করে। আমাদের প্রস্তাব ছিল দ্রুত চারটি ডিপো নির্মাণ, সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে গাড়ি দেওয়া, পুরনো গাড়ি সরকারের পক্ষ থেকে কিনে নেওয়া ও কোম্পানি গঠন। আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। করোনায় সব থেমে যায়। বর্তমানে দুই সিটির মেয়র আবার উদ্যোগ নিয়েছেন। গত মাসে এ নিয়ে একটা সভা হয়েছে। আগামী ১০ নভেম্বর ফের সভা আছে। আশা করছি একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারব। বাস মালিকরা রেশনালাইজেশনে রাজি। সরকারের কাজগুলো যত দ্রুত হবে তত দ্রুত নগরবাসী একটা ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা পাবে।

সর্বশেষ খবর