রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বড় অপরাধ বাড়ছে ছোটদের

দেশজুড়ে সক্রিয় ২০০ কিশোর গ্রুপ, বিচরণ বেশি মোহাম্মদপুর মিরপুর এবং উত্তরায়

জিন্নাতুন নূর

বড় অপরাধ বাড়ছে ছোটদের

বয়স তাদের একেক জনের ১৪ কি ১৫। এই বয়সেই ধারালো এবং স্বয়ংক্রিয় দেশি-বিদেশি অস্ত্র চালানো শিখে নিয়েছে। কেউ চুরি আবার কেউ ছিনতাই করছে। বয়সে কাঁচা হলেও করছে পেশাদার সন্ত্রাসীর মতো আচরণ। মানুষ খুন করতেও তাদের হাত কাঁপে না। কিশোর বখাটেদের কেউ কেউ করছে যৌন হয়রানি। জড়াচ্ছে সাইবার অপরাধেও। যে বয়স খেলাধুলা ও পড়ালেখা করার কথা সে বয়সেই তারা অপরাধের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। এরা কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, সাধারণত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের কাজেই প্রভাবশালীরা কিশোর অপরাধীদের বেশি ব্যবহার করছেন। বিগত কয়েক বছরের অপরাধের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রয়ের মতো অপরাধগুলোতেও শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। সূত্রমতে, দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক গ্রুপ সক্রিয়। আর রাজধানীতে সক্রিয় আছে কিশোর গ্যাংয়ের ৪২টি গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য ১০ থেকে ১৫ জন এবং বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত নিজেকে হিরো প্রমাণিত করে একজন কিশোর অন্য কিশোরের চেয়ে এগিয়ে আছে এমনটি মনে করেই বেশিরভাগ কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণের সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কিশোর অপরাধের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত একটি এলাকায় যখন কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে তখন পাল্লা দিয়ে আরেক এলাকাতেও কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। আর এক-একটি এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং থাকে এবং তাদের রয়েছে অভ্যন্তরীণ শনাক্তকরণ চিহ্ন। তবে যে কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে তাদের পরিবার এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। এরই মধ্যে তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দমনের লক্ষ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে কিশোর অপরাধীদের তালিকা হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি কিশোর গ্যাংয়ের নাম ‘খাইয়া ফেলামু’। এই দলের সদস্যদের শরীরে আছে বিশেষ লোগো বা উল্কি। তারা তাদের বুকের ওপর বামদিকে বিশেষ এই উল্কি আঁকে। ‘খাইয়া ফেলামু’ দলের প্রায় সব সদস্যের শরীরেই আছে বিশেষ উল্কি। জানা যায়, কিশোর গ্যাংটির বিশেষত্ব তথা পরিচিতি চিহ্নই হলো এই বিশেষ উল্কি। মোহাম্মদপুর ছাড়াও রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার কিশোর অপরাধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর এদের অনেকেই নিজ শরীর অলঙ্করণে উল্কি আঁকছে। সম্প্রতি কিশোর অপরাধীরা বিভিন্ন সামাজিক অ্যাপস যেমন-টিকটক, লাইকি ইত্যাদির সাহায্যে বাইক স্ট্যান্ট করে অন্য কিশোরদের অপরাধে আকৃষ্ট করছে। শরীরে উল্কি আঁকা ছাড়াও তারা চুলে হরেক রকম রং করছে। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প এলাকায় ‘তেরে নাম বাবু’ নামে আরেক কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান মিলেছে। ঢাকার কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে এটি বড়। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনেছে। র‌্যাবের কাছ থেকে সম্প্রতি এসব তথ্য জানা যায়। কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে আরও আছে- ‘চাপায়-দে’, ‘লারা-দে,’ ‘ও দেখে-ল’ চিনে-ল’, ‘কোপাইয়া-দে’, ‘ব্ল্যাক রোজ’, ‘ক্যাসল বয়েজ’, ‘ভাইপার’, ‘তুফান, গ্রুপ’ ইত্যাদি। জানা যায়, পাড়া-মহল্লা ও বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং ভাসমান পথশিশু ও টোকাইরা কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সংস্কৃতি শুরুতে ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও পরে মেট্রোপলিটন কেন্দ্রিক তা বিস্তার লাভ করে। মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোররাই অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তবে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এ ধরনের অপরাধে তুলনামূলক কম জড়াচ্ছে। ঢাকার বস্তিকেন্দ্রিক এলাকাগুলোর কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং উত্তরা এলাকায় কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেশি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজে আগের তুলনায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে শিশুরা সহিংস অনেক কনটেন্ট দেখে ফেলছে। বর্তমানে শিশুরা অনেক ভিডিও খেলছে যার বেশিরভাগই সহিংসতামূলক। এই গেমগুলো শিশুদের সহিংস করে তুলছে। শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার দুটো ক্ষেত্রের একটি হচ্ছে পরিবার অন্যটি তার স্কুল। আশঙ্কা করছি বেশ কিছু পরিবারের অভিভাবকের শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য যে ভূমিকা পালন করার কথা তা তারা করছেন না। আবার বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেক প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে ব্যক্তিত্ব ও জীবন গঠনের শিক্ষা অনুুপস্থিত। এসব বিষয়ই শিশুকে সহিংস করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশুর সুষ্ঠুভাবে মানসিক বিকাশের দায়িত্ব শুধু পরিবারের একার নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুর শিক্ষা ব্যবস্থাকে আনন্দদায়ক করে তুলতে হবে।

পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে অনেক সময় অভিভাবকরা শিশুকে অসৎ উপায় গ্রহণে উৎসাহিত করে, এটি ঠিক নয়। একইসঙ্গে সামাজিক পরিবেশের মধ্যেও পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুদের খেলাধুলায় পরিবর্তন আনতে হবে। অতিরিক্ত সময় অনলাইনে থাকার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এর মাধ্যমে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এবং তারা সহিংস কর্মকান্ডে জড়াবে না। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে কিশোর অপরাধীরা মাদকে বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে এদের অনেকেই মাদক বিক্রি ও বহনের কাজও করছে। তারা নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে কিশোর গ্যাং এখন শুধু কিশোর গ্যাং এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এলাকার উঠতি মাস্তান ও বড় নেতাদের প্রশ্রয়ে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক বেচাকেনা, ইভ টিজিং এবং অস্ত্রের মহড়া দেওয়ার মতো অপরাধই তারা বেশি করে। আবার সংখ্যায় খুব কম হলেও কিশোরীরাও ধীরে ধীরে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর