রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

চাকরি ছেড়ে কৃষিতে শিক্ষিত প্রজন্ম

শামীম আহমেদ

চাকরি ছেড়ে কৃষিতে শিক্ষিত প্রজন্ম

কৃষকের সন্তানও এখন করতে চান না কৃষিকাজ। সেই মুহূর্তে চাকরি ছেড়ে কৃষিতে ঝুঁকছেন অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কেউ করছেন গবাদি পশুর খামার। বুয়েট থেকে পাস করে পালন করছেন হাঁস-মুরগি বা চাষ করছেন মাছের। নার্সারি, ফলের বাগান বা সমন্বিত খামার করে লাখ টাকা আয় করছেন অনেকে। কেউ আবার কৃষকদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত করে সার ও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করেছেন। মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে সেইসব বিষমুক্ত সবজি, শস্য ও মাছ-মাংস পৌঁছে দিচ্ছেন সারা দেশে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সংশ্লিষ্টদের মতে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হওয়া শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা এখন দুই-তিন লাখের কম হবে না। করোনার প্রভাবে যখন চারদিকে কর্মহীনের ছড়াছড়ি, তখনো বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে কৃষি খাত। এমনকি কাজ হারিয়ে গত কয়েক মাসে অসংখ্য মানুষ গ্রামে ফিরে কৃষি ও খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কেউ আবার চাকরি বা ব্যবসার পাশাপাশিও বাড়তি আয়ের জন্য গড়ে তুলছেন খামার। অনেকে কৃষক থেকে ফসল সংগ্রহ করে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তা বিক্রির ব্যবস্থা করছেন সারা দেশে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে টাঙ্গাইলে নিজ এলাকায় ফিরে কৃষি ও খামারে আত্মনিয়োগ করেছেন আতাউর রহমান। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বাগধনা গ্রামের আল হেলাল উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরির পেছনে না ঘুরে কৃষি কাজ, ফলদ বাগান, দেশি মুরগির খামার, কবুতর পালনসহ কৃষিভিত্তিক কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। খুলনার দাকোপ এলাকার উচ্চশিক্ষিত তরুণী হাসনা হেনা সাড়া ফেলেছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছায়াবাণী করে। এরপর দীর্ঘ ১৪ বছর কাটিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। ফিরে এসে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে আলোড়ন তুলেছেন। বিষমুক্ত সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি ও ভেড়া পালন ও মাছ চাষ করে শুধু নিজেই লাখ টাকা উপার্জন করছেন না, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন অনেকের। খুলনার ডুমুরিয়ার খর্ণিয়ায় যুবক পল্লব ঘোষ ভারত থেকে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পাস করে বর্তমানে ফুড ইন্সপেক্টর হিসাবে কর্মরত। তবে চাকরিতেই আটকে থাকেননি তিনি। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভিত্তিতে চুইঝাল ও আম চাষ করে সাড়া ফেলেছেন এলাকায়। এমন লাখ লাখ শিক্ষিত যুবক-যুবতী এখন ঝুঁকছেন আদি পেশা কৃষিতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্সে দ্বিতীয় এবং মাস্টার্সে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন কুষ্টিয়ার ছেলে দেলোয়ার জাহান। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পেয়েছিলেন চাকরির সুযোগ। কিন্তু যাননি। ঢাকায় কৃষি ও পরিবেশ সাংবাদিকতায় নিজেকে জড়ান। এরপর পুরোদমে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করেন। সঙ্গীদের (সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেলোয়ারের পরিচিত ছিলেন) নিয়ে ২০১৩ সালে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলি গ্রামে জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন। গড়ে তোলেন ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামে একটি সংগঠন। বর্তমানে মানিকগঞ্জে রয়েছে নিজস্ব খামার। ঢাকার মোহাম্মদপুরে রয়েছে প্রাকৃতিক কৃষির বিপণন কেন্দ্র। বিভিন্ন জেলায় গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষকদের দল। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সেই সব জেলা থেকে ঢাকার বিপণন কেন্দ্রে আসছে বিষমুক্ত সবজি, শস্য, ঘানি ভাঙা তেল, ফল, মধুসহ নানা কৃষিপণ্য।

দেলোয়ার জাহান বলেন, আমি কৃষকের সন্তান। এটা গর্ব করে বলি। কৃষি আমার স্বপ্ন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করায় এলাকায় গেলে অনেকেই চাকরির বিষয়ে জানতে চান। তাই বাড়ি কুষ্টিয়ায় হলেও সেখানে গিয়ে কৃষিকাজে যুক্ত হতে পারিনি। কৃষিকাজকে এখানে অচ্ছুতের কাজ মনে করা হয়। তাই উচ্চ শিক্ষিতরা এই কাজে আসতে চায় না। তবে ধারণা বদলাচ্ছে। এখন অনেকে আসছেন। বাংলাদেশে এখন কৃষিকাজ করে ভালোভাবেই জীবিকা নির্বাহ সম্ভব। সমন্বিত খামার করে অনেকেই লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন।

ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতকোত্তর করা ইকবাল হোসেন জুপিটার কৃষি সরঞ্জাম বিপণনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে ১০ বছরের পুরনো চাকরি ছেড়ে ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ফিরে যান টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর পাতলাচড়ায় নিজ গ্রামে। কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা ও কৃষি নিয়ে নিজের অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে শুরু করেন বিষমুক্ত সবজি আন্দোলন। ৪৬ শতাংশ জমিতে করেছেন নিজস্ব খামার। পাতলাচড়া শ্রমজীবী সমিতির ৪৯ জন সদস্যকে নিয়ে শুরু করেন রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত সবজির আবাদ। হাঁস-মুরগি পালন করাচ্ছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। হাইব্রিডের চাপে হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন স্থানীয় জাতের ফসলের বীজ সংগ্রহ করে সরবরাহ করছেন। ‘কৃষির সাথে-কৃষকের সাথে’ স্লোগান নিয়ে ‘প্রযত্ন’ নামের ফেসবুক গ্রুপ করে আবাদ করা সবজি, ফসল ও হাঁস-মুরগি বিক্রির ব্যবস্থা করছেন সারা দেশে। তিনি বলেন, এখন অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী কৃষিতে আসছে। করোনায় এটা অনেক বেড়ে গেছে। তারা স্থায়ী হলে কৃষির উন্নয়ন হবে। আমার সমিতির সদস্যদের কেউ ভ্যানচালক, কেউ দিনমজুর, কেউ কৃষক। বসতভিটা থাকলেও অধিকাংশই সেখানে কোনো আবাদ করত না। এখন সবার বসতভিটায় অন্তত লাউ গাছ আছে। হাঁস-মুরগি পালন করছেন। পুকুরে স্থানীয় জাতের মাছ পালন করছেন। যার অতিরিক্ত জমি আছে তিনি অন্যান্য ফসল ও সবজি আবাদ করছেন। কোনো কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে না। আমি বেশি দাম দিয়ে কিনে নিচ্ছি। মধ্যস্বত্ত্বভোগী কমে যাওয়ায় ভোক্তাও সাশ্রয়ী মূল্যে বিষমুক্ত খাবার পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ডাক্তারকে টাকা দেওয়ার চেয়ে কৃষককে দেওয়া ভালো। এ জন্যই বিষমুক্ত কৃষি আন্দোলন শুরু করি। ময়মনসিংহে ২২ জন চিকিৎসক আছেন যারা আমার নিয়মিত ক্রেতা। ৮ জন শিক্ষিত বন্ধু আমার কাজে সহযোগিতা করছেন। সবাই অংশীদার। একজন বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে চাকরির পাশাপাশি এই কাজ করছেন। আরেকজন আছেন আইনজীবী। লকডাউনের সময় যখন নামমাত্র দামে সবজি বিক্রি হচ্ছিল না, তখন অনেক বইপত্র ঘেটে, কৃষিতে উচ্চশিক্ষা নেওয়া পরিচিতজনের সঙ্গে আলাপ করে করলার শুঁটকি করেছিলাম। এটা দীর্ঘদিন রাখা যায়, অধিকাংশ পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। এই জ্ঞানটা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষক লাভবান হতো। এগুলো নিয়ে গবেষণা দরকার। কৃষি নিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়া তরুণ-তরুণী কৃষিতে এলে এই খাতটি বদলে যেত।

সর্বশেষ খবর