মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা পরবর্তী বিনিয়োগ ধরতে কর্মপরিকল্পনা

সংশোধন করা হচ্ছে দুটি আইন, প্রত্যাহার হচ্ছে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ

মানিক মুনতাসির

করোনা পরবর্তী বিনিয়োগ ধরতে কর্মপরিকল্পনা

সারা বিশ্বে মহামারী রূপ নেওয়া কভিড-পরবর্তী দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ধরতে কর্মপরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করছে। আরও সহজ করা হচ্ছে করনীতি। ইকোনমিক জোনে শিল্প স্থাপনের ওপর প্রস্তাবিত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ প্রত্যাহারের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এ ছাড়া ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নতির জন্য এ-সংক্রান্ত দুটি আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে আগামী মাসের মধ্যে। এর জন্যও কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো, যা বিদেশি বিনিয়োগ ধরতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে সরকার। অর্থ বিভাগ, বেজা ও বিডা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, করোনাকালীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ছয়টি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এগুলো করোনার পরও থাকবে। এ জন্য এখন থেকেই এসব বাধা পেরোনোর প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। ইতিহাসের ভয়াবহ এই সংকটে অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক রাখতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ জোগাতে এবং সব জটিলতার অবসানে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস (একমুখী সেবা) শতভাগ চালু করা, স্বল্প সুদের ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, ঘন ঘন বিনিয়োগ নীতি (পলিসি) পরিবর্তন, এসব ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং সবুজ (পরিবেশবান্ধব) বিনিয়োগ বাড়ানো। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও এসব চ্যালেঞ্জকে বিনিয়োগের জন্য চিহ্নিত করেছে বলে জানা গেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি আইন সংশোধন, নীতির পরিবর্তন, করনীতি সহজীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে বিদেশি বিনিয়োগ ধরতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুটি আইনে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর একটি দেউলিয়াত্ব আইন, ১৯৯৭ ও অন্যটি স্মল কজেস কোর্টস অ্যাক্ট, ১৮৮৭। এ আইন দুটি সংশোধন করা হলে সহজ হবে বিদেশি বিনিয়োগ প্রক্রিয়া। জাপানি কোম্পানিগুলো বলছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত ব্যবসা ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত নিয়মকানুন আরও সহজ করা। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে প্রতি বছর অন্তত ৫০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে বলে মনে করেন জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অরগানাইজেশনের (জেট্রো) কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইউজি আন্দো। সম্প্রতি ইআরএফের সঙ্গে এক আলোচনায় অংশ নিয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইনি বাধাগুলো দূর করার পাশাপাশি অবকাঠামোর উন্নয়ন ও নীতিসমূহ আরও সহজ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ইআরএফের এক আলোচনায় বলেন, দেউলিয়া বিষয়ক আইন, ১৯৯৭ সংশোধনে ভারতের গৃহীত পদক্ষেপ অনুসরণ করা হচ্ছে। এ জন্য ভারতের সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের আইন যতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে সেটিকে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২০২১ সালের মধ্যে এই সূচক দুই অঙ্কে নামিয়ে আনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে লক্ষ্যেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। এদিকে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৬৮। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই সূচক তিন অঙ্ক থেকে দুই অঙ্কে নামিয়ে আনতে চায় সরকার, যা মূলত সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। এ তালিকায় যে দেশের অবস্থান যত ওপরে সে দেশের ব্যবসার পরিবেশ তত উন্নত। বর্তমান বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান ৬৩তম। মিয়ানমার ১৬৩। গত এক বছরে ভারত এ সূচকে ১৪ ধাপ এগিয়েছে। আর পাকিস্তান এগিয়েছে ২৮ ধাপ। পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থান ১০৮। অবশ্য বাংলাদেশও এক বছরে এ সূচকে এগিয়েছে ৮ ধাপ। এখানে ভারতের সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক পরিবেশ পরিবর্তনকে মডেল হিসেবে রেখেই সামনের দিনে পথ চলতে চায় বাংলাদেশ। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার অনেক দিন ধরেই কাজ করছে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের গ্যাস-বিদ্যুতের অবস্থান অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাকি যে সূচকগুলো রয়েছে সেগুলোর ওপর আরও দ্রুত কাজ করা দরকার। এ ছাড়া দুটি আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। ডিসেম্বরের মধ্যে আইন দুটি সংশোধন করতে পারলে আমরা অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারব বলে আশা করা যায়।’ এ ছাড়া সরকারের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। কোনো সংস্থাই সেবাগ্রহীতাদের সময়মতো কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারছে না দক্ষ জনবলের অভাবে। এ জন্য দক্ষ জনবল তৈরিতে সংস্থাগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং স্বল্প কার্বন নিঃসরণে সবুজ বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে সবুজ বিনিয়োগের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের নির্দেশনাও দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চাই বিনিয়োগনীতি আরও সহজ হোক। দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেশি বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে তাদের আকর্ষণমূলক কিছু দিতে হবে। এ জন্য আমরা উপযুক্ত অবকাঠামো এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ করছি।’ সরকারও বিভিন্ন আইন সংশোধন ও নীতির সংস্কারে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর