শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রেশম চাষে স্বপ্ন দেখছেন নারীরা

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্্

রেশম চাষে স্বপ্ন দেখছেন নারীরা

কৃষি কিংবা প্রযুক্তি- সব সেক্টরেই আজ এগিয়ে বাংলাদেশ। আর এই এগিয়ে যাওয়ার পথসঙ্গী শুধু পুরুষই নন, এতে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে নারীদেরও। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আজ সমান তালে দেশের নানা উন্নয়নে যুক্ত হচ্ছেন। আর তেমনই হারিয়ে যাওয়া কৃষিশিল্পের ঐতিহ্য বহনকারী রেশম চাষে উদ্যোগী হয়ে স্বপ্ন দেখছেন নারীরা। রেশম চাষ করে নিজেদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি দেশের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। এমন দৃশ্যের দেখা মেলে গাজীপুরের কাপাসিয়ার কয়েকটি এলাকায়। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের শত শত নারী এখন রেশম চাষে ঝুঁকছেন। সরকারি খাল ও নদীর তীরে তুত গাছ রোপণ করে রেশম পোকার খাবারের জোগান দিচ্ছেন তারা নিজ উদ্যোগে। একজনের দেখাদেখি অন্য নারীরাও এগিয়ে আসছেন রেশম চাষে।

গাজীপুরের কাপাসিয়ার নিভৃত পল্লী বরহর গ্রাম। এ গ্রামের অধিকাংশ লোকই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে সিংহভাগ কৃষকের নিজস্ব কোনো জমি না থাকায় অন্যের জমিতে কাজ করেন। কৃষিকাজে জীবনমান উন্নত না হওয়ায় তাদের ভাগ্যের চাকা যেন ঘুরছিল না কোনোভাবেই। এমন অবস্থায় কৃষকের দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড। গ্রামের কিষানিদের স্বাবলম্বী করতে তারা এলাকার নারীদের রেশম চাষে উদ্বুদ্ধ করে। সরকারের এমন উদ্যোগে কয়েক বছরেই রেশম চাষ বদলে দিয়েছে গ্রামীণ নারীদের জীবনধারা। এখন তো এ রেশমেই জড়িয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন।

কাপাসিয়া উপজেলার করিহাতা ইউনিয়নের দিঘিরকান্দা ও রায়েদ ইউনিয়নের বরহর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার চিত্র দেখা গেছে। দুটি গ্রামের বাড়ি বাড়ি তৈরি হয়েছে রেশম চাষের পলু ঘর। রেশম চাষের মাধ্যমে দুই গ্রামের নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা আরও অনেককেই আগ্রহী করে তুলছে।

বরহর গ্রামের জাহেদা আক্তার বলেন, তার স্বামী মাঠে কৃষিকাজ করেন। সংসারের কাজ শেষে তাকে বাড়িতে বেশ কিছু সময় অলস কাটাতে হতো। স্বামীর সামান্য রোজগারে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ নানা খরচ জোগানে সমস্যা তৈরি হতো তাদের পরিবারে। পাঁচ বছর আগে তিনি বাড়ির বারান্দায় রেশম চাষ শুরু করেন। আর এতে যেন পাল্টে যায় তাদের সংসারের চিত্র। প্রতি বছর জাহেদা আক্তার নিজেই আয় করছেন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এতে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

এ গ্রামেরই বধূ শিল্পী রানী বলেন, তাদের হিন্দুপল্লীতে প্রতিনিয়তই রেশম চাষে ঝুঁকছেন নারীরা। রেশম চাষ করে সংসারের অলস সময়ে ঘরে বসে একজন নারী হিসেবে বাড়তি আয় করতে পারছেন তিনি। আগে নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য স্বামীর দিকে চেয়ে থাকতে হতো। এখন ঘরে বসেই আয় করছেন টাকা। নিজের ও সন্তানদের খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতেও কিছু টাকা তুলে দিতে পারছেন তিনি। এভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা তাকে অন্য রকম আনন্দ দেয় বলে জানান শিল্পী রানী।

দিঘিরকান্দা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, কিছুদিন আগেও অভাবের সংসার ছিল তার। অভাব মোচনে তার স্ত্রী রেশম চাষ শুরু করেন। তিনি মাঠে কাজ করেন আর তার স্ত্রী বাড়িতে রেশম চাষ ও গবাদি পশু পালন করেন। এতে কয়েক বছরেই তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র, গাজীপুরের অধীন গাজীপুরের কাপাসিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে রেশম চাষ হচ্ছে। এ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, কাপাসিয়ায় হতদরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে রেশম চাষ শুরু করা হয় কয়েক বছর আগে। সমন্বিত প্রকল্পের অধীন নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের এ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দুটি গ্রামের ৩০ জন নারীর বাড়িতে পলুুঘর নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়েছে। কাপাসিয়ার রায়েদ ইউনিয়নের বরদার খালের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তুত গাছ রোপণ করা হয়েছে। এসব তুত গাছ থেকেই রেশম পোকার খাবার সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি এসব তুত গাছ সবুজের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। লাভজনক এ রেশম চাষে এলাকার বহু নারী এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। আর একজনকে দেখে অন্যজনও রেশম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এতে কাপাসিয়ার এসব এলাকায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে রেশম চাষ। সরকারি এ কর্মসূচির বাইরেও গ্রামের আরও শতাধিক পরিবারের নারীরা রেশম চাষ করে আর্থের জোগান দিচ্ছেন। তাদের সহায়তায় রেশম বোর্ড থেকে চলতি বছর বাড়ি বাড়ি রোপণের জন্য তুত গাছের দেড় হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে রেশম পোকা বিতরণ থেকে গুটি তৈরি পর্যন্ত সবকিছু তদারক করছে রেশম বোর্ড। পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে নেয় রেশম বোর্ড। আর এ থেকে সুতা উৎপাদন করা হয়। বছরে চারবার রেশমগুটি উৎপাদন করা যায় বলে জানা গেছে। প্রতি বছর ভাদ্র, অগ্রহায়ণ, চৈত্র ও জ্যৈষ্ঠ মাসে রেশমগুটি সংগ্রহ করা হয়। কৃষককে রেশম পোকার ডিম প্রদানের পর কয়েক দিনেই জন্ম নেয় পোকা। পরে তুত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে পোকার খাবার সরবরাহ করা হয়। এভাবে দেড় মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় গুটি। আর এখান থেকে তৈরি হয় রেশম সুতা। বর্তমানে ১ কেজি রেশম সুতা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা দরে। প্রতি ৭ কেজি গুটি থেকে ১ কেজি সুতা উৎপাদন করা যায় বলে জানা গেছে।

গাজীপুরের আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করতেই রেশম চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছরেই এ চাষের মাধ্যমে গাজীপুরের কাপাসিয়ার শত শত নারী স্বাবলম্বী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। নিজ বাড়িতে সংসারের কাজের পাশাপাশি রেশম চাষে সামান্য সময় দিয়ে খুব সহজেই ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা বাড়তি আয় করতে পারছেন তারা। রেশম চাষের মাধ্যমে বিনা খরচে গ্রামের কিষানিদের কয়েক মাস পর পর ভালো টাকা আয়-রোজগার করতে পারাটাই সরকারের সার্থকতা বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, রেশম চাষের প্রধান রসদই হচ্ছে পোকার খাবার তুত গাছের পাতা। রেশম পোকার খাবার সরবরাহের জন্য বিভিন্ন খাল ও নদীর তীরে তুত গাছ রোপণ করা হচ্ছে। এতে কোনো জমিরও অপচয় হচ্ছে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর