রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ডিজিটাল যুগে অ্যানালগ ট্রাফিক

অকার্যকর স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম, হাত উঁচিয়ে লাঠি দিয়েই ট্র্রাফিক নিয়ন্ত্রণ

জিন্নাতুন নূর

ডিজিটাল যুগে অ্যানালগ ট্রাফিক

ডিজিটাল যুগেও মেগাসিটি ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। অথচ যানজট নিয়ন্ত্রণে এক দশকের বেশি সময়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও এখনো ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বাঁশি, লাঠি, রশি এমনকি নিজের হাতের ওপর নির্ভর করেই ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ করছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্র্রাফিক বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, নগরীতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করা হলেও তা অকার্যকর। আবার আধুনিক রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে শহরের চার-পাঁচটি স্থানে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিরিটি (বিআরটিএ)-কে পেশাদারি মনোভাব দেখাতে হবে। তাদের মতে, যতদিন শহরজুড়ে বড় বড় কনস্ট্রাকশন কাজ শেষ না হবে ততদিন পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি দিয়েও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। রাজধানীতে এখন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ইউলুপের মতো বিশাল বিশাল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ চলছে। আর এই কাজগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে না। ঢাকায় একমাত্র বড় ও ভিআইপি রাস্তা যা উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ-মতিঝিল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পুরো রাস্তাজুড়েই এখন কনস্ট্রাকশন কাজ চলছে। এই অবস্থায় অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্প যে রাস্তা মানুষ ব্যবহার করছেন সেখানেও লোড বেশি হয়ে যাচ্ছে। আবার সড়কে বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল করছে। এর ফলে এসব রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, ট্রাফিক সিগন্যালের উল্লেখ যোগ্যসংখ্যক বাতি অকেজো। যেগুলো চলছে সেগুলোও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে খুব একটা কাজে আসছে না। আবার সড়কের মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন ট্রাফিক নির্দেশনার জন্য সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হলেও সেগুলো ধুলোবালিতে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক নির্দেশক সাইনবোর্ড আবার ব্যানার-পোস্টারে ঢাকা পড়েছে। এ ছাড়াও ঢাকার অধিকাংশ প্রধান সড়কের গতিরোধকের উপরের সাদা রংও উঠে  গেছে।

 

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার ট্রাফিক (উত্তর) মো. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার উত্তর থেকে দক্ষিণে একটিই রাস্তা। এর সঙ্গে ৪৬টি ইন্টারসেকশন আছে যেগুলো পূর্ব-পশ্চিমে। ফলে সকাল থেকে সব গাড়ি ভিআইপি রোডে এসে ঢুকে। আর যখন ভিআইপি রোডে এক জায়গায় প্রচুর গাড়ি জমে যায় তখন আর স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল কাজ করে না। এই অবস্থায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ম্যানুয়ালি সময় বাড়িয়ে গাড়ি জট কমাতে হয়। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যকর তখনই হবে যখন শহরের বড় উন্নয়ন কাজগুলো শেষ হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ, সিটি করপোরেশন, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। এ ছাড়া বাস রুট ফ্রাঞ্চজাইজির কাজ চলছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হলে আশা করি যানজট কমে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বিআরটিএ যেসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে তা কখনই রাস্তার ধারণক্ষমতা জেনে দিচ্ছে না। আবার সড়কে অনেক সময় পথচারীরা দাঁড়িয়ে থাকেন, সড়কের ওপর গাড়ি পার্কিং করেন অনেকে। এতে সড়কে গাড়ির চলার মতো জায়গাও কমে আসে। আর যানজট যখন তৈরি হয় তখন ট্রাফিক সিগন্যাল কাজ করে না। মোড় দিয়ে যতগুলো গাড়ি যাওয়ার ক্ষমতা থাকার কথা তার থেকে বেশি গেলে সিগন্যালও কাজ করে না। বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো  পেশাদারি সংগঠনের নয় যারা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানসম্মত সমাধান দেবে। এই সংগঠনগুলো উল্টো ভূমি ব্যবহারের ঘনত্ব বাড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, রাজধানীতে গাড়ির এতই চাপ যে ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে গাড়ি চালালে যানজট আরও বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য ট্রাফিক পুলিশরা এখনো এনালগ পদ্ধতিতেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থাকলেও তা নামমাত্র। সেখানে নিয়ম করে লাল-সবুজ ও হলুদ আলো জ্বললেও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কবে নাগাদ আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চালু হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। জানা যায়, আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন সময় প্রকল্প নেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্টের আওতায় ২০০৫ সালে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ৫৯টি সড়কের মোড়ে স্বয়ংক্রিয়  বৈদ্যুতিক সিগন্যাল বাতি স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালের নভেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রাথমিক প্রকল্পটি শেষ  এবং তা চালুও হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও রাজধানীর ৬২টি সড়কের মোড়ে নতুন করে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি বসানোর কাজ চলছে। প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও করা হয়। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিআরটিএকে পেশাদারি মনোভাব দেখাতে হবে। ধারণক্ষমতা না থাকলে ঢাকায় নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ রাখতে হবে। ছোট ব্যক্তিগত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করলেও বৃহত্তর স্বার্থে বড় বাসের রেজিস্ট্রেশন চালু রাখতে হবে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকেও (রাজউক) হিসাব করে ভূমি ব্যবহারে যেতে হবে। অর্গানাইজড পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে হবে। বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজির আওতায় ঢাকা চাকার মতো অর্গানাইজড বাস সিস্টেমের মাধ্যমে কম গাড়িতে বেশি মানুষের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা শহরে যেসব এলাকা অপরিকল্পিত রয়ে  গেছে অর্থাৎ যেখানে বাস ঢুকছে না সেখানে ল্যান্ড কনসোলিডেশন পলিসি করে পুনঃসংস্কার করে রাস্তায় গ্রিড বের করতে হবে। রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। নন মোটর এক্টিভিটি যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। ফুটপাথকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর