বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধকালে ও ১৫ আগস্টের পর নিদারুণ কষ্ট করেন শেখ রাজিয়া নাসের

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় বিপথগামী কিছু সেনা সদস্যের নারকীয় হামলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে নিহত হন শেখ আবু নাসের। তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন রাজিয়া নাসের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মিরা শেখ আবু নাসেরের টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে সন্তানদের নিয়ে ঢেঁকিঘরে আশ্রয় নেন শেখ রাজিয়া নাসের। রাজাকাররা জানতে পারেন, শেখ নাসেরের পরিবার ঢেঁকিঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে গিয়ে তারা সেটিও পুড়ে দেয়। এ সময় শেখ রাজিয়া নাসের তার সন্তান শেখ রুবেলকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। ফিডারটি কেড়ে নিয়ে     রাজাকাররা ভেঙে ফেলে এবং ঘরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোনো রকমে সন্তানদেরকে নিয়ে তিনি জীবন বাঁচান। শেখ নাসের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছেলে শেখ হেলাল ও ভাতিজা শেখ জামাল, তারাও শেখ নাসেরের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেন। শেখ হেলাল ও শেখ জামাল ছোট থাকায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন এবং তাদের অস্ত্রের গুলি লোড করে দিতে সাহায্য করতেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে শেখ নাসের ভারতে চলে যান। সেখানে টেনিং নিয়ে ফিরে এসে সুন্দরবন এলায় সশস্ত্রযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭৫ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনিরা শেখ নাসেরকেও হত্যা করে। পরদিন ১৬ আগস্ট যখন টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতাকে দাফন করা হচ্ছে, শেখ রাজিয়া নাসের তখন সন্তানদের নিয়ে লঞ্চে করে খুলনা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় আসেন। কিন্তু খুনিচ? টুঙ্গিপাড়ায় সেই লঞ্চ ভিড়তে দেয়নি। পরে সন্তানদের নিয়ে লঞ্চে করে আবার খুলনায় ফিরে যান তিনি। বাড়িতে ফিরে দেখেন খুনি সরকার তার বাড়ি সিলগালা করে রেখেছে। নিজের বাড়িতে শতচেষ্টা করেও প্রবেশ করতে পারেননি। একপর্যায়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। পরে রাতে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। তখন শেখ রাজিয়া নাসের প্রায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাবার বাড়িতেও খুনিরা তাকে থাকতে দেয়নি। তার বাবার ওপর নানা চাপ দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর খুনিচ?। একপর্যায় সেখানে টিকতে না পেরে পাবনায় দাদার বাড়িতে চলে যান রাজিয়া নাসের। কিন্তু সেখানেও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। এ সময় তার সন্তানদের স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়নি। তখন বড় ছেলে শেখ হেলাল ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্যাডেট কলেজে একটা গ্রুপ হানা দেয় শেখ হেলালকে তুলে আনার জন্য। কিন্তু শিক্ষক ও ছাত্রদের বিশেষ করে ক্যাডেট কলেজের সেই সময়কার প্রিন্সিপালের বাধার মুখে শেখ হেলাল রক্ষা পান। শেখ রাজিয়া নাসের সন্তানদের নিয়ে আবার খুলনায় ফিরে আসেন। এখানে সেখানে তিনি মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন সাত সন্তান নিয়ে। বড় মেয়ে মিনা ও ছেলে শেখ জুয়েলকে খুলনা সরকারি স্কুলে ভর্তি করানো হলেও জিয়া সরকারের নির্দেশে স্কুল থেকে তাদের নাম কেটে দেওয়া হয়। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তাদের পারিবারিক ব্যবসাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সাত সন্তান নিয়ে নিদারুণ অর্থ কষ্টে পড়েন শেখ রাজিয়া নাসের। অবশেষে ১৯৮১ সালে তার বাড়ির সিলগালা খুলে দেওয়া হয়। পরে তিনি সন্তানদের নিয়ে সেখানে ওঠেন। ইতিমধ্যে ছেলে শেখ হেলাল ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

শেখ রাজিয়া নাসের অত্যন্ত প্রগতিশীল ও সংস্কৃতি মনা ছিলেন। তিনি সেই সময় খুলনায় সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন। এই মহীয়সী নারী ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের সঙ্গে বিবাহ হয়।

রাজিয়া নাসেরের বড় ছেলে বাগেরহাট-১ আসনের এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন ও খুলনা-২ আসনের এমপি শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, নাতি বাগেরহাট-২ আসনের এমপি শেখ সারহান নাসের তম্ময়। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার চাচি রাজিয়া নাসের। ১৯৭৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা লন্ডন থেকে বেবিসিটারের কাজ করে জমানো টাকা দিয়ে তার চাচি ও ভাই-বোনদের জন্য শীতের কাপড়সহ প্রথম সহায়তা পাঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ভারতের দিল্লিতে ছিলেন। এরপর তিনি সেখান থেকে তার চাচিসহ ভাই-বোনদের জন্য সহায়তা পাঠিয়ে ছিলেন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁর চাচি রাজিয়া নাসের তাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অভিভাবক।

সর্বশেষ খবর