বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কামড়ের দাগে খুনিরা শনাক্ত

চীনা নাগরিক হত্যায় চার্জশিট

মাহবুব মমতাজী

সিকিউরিটি গার্ডের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড়ের দাগ দেখে চীনা নাগরিক জিয়ানহুই গাও (৪৭) হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ হত্যা মামলার চার্জশিট ১৬ নভেম্বর আদালতে দাখিল করেছে ডিবি পুলিশের গুলশান বিভাগ। এতে আবদুর রউফ ও ইনামুল হক নামে দুজন সিকিউরিটি গার্ডকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এর আগে বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৮২ নম্বর বাড়ির একটি ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চীনা নাগরিক গাওয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি চীন থেকে নির্মাণসামগ্রী এনে পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরে সরবরাহ করতেন।

গাওয়ের অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি সুপারভাইজার, ড্রাইভার, কাজের বুয়া, দোভাষীসহ ব্যবসায়িক অংশীদারদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানার চেষ্টা করা হয় কারও সঙ্গে তার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল কিনা। ওই বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও রেকর্ডের ব্যবস্থা না থাকায় তদন্তসংশ্লিষ্টরা কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ডিবি পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, তারা মি. গাওয়ের গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের ‘উই চ্যাট’ হিস্ট্রি যাচাই করে দেখেন। ওই দিন সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা কোনো রিপ্লাই দেননি। ওই দিন রাতের শিফটে থাকা সিকিউরিটি গার্ড আবদুর রউফ তাদের জানান, ওই দিন রাত ১১টায় বাড়ির বাইরের তালা তিনি লাগিয়েছেন এবং পরদিন সকাল ৭টায় নিজেই তালা খুলেছেন। তারা ধারণা করেন, বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে হত্যাকা-টি হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে লাশ ছয় তলা থেকে নামিয়ে পেছনের গেট দিয়ে বাইরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যেটি সিকিউরিটি গার্ডদের জানার কথা। সিকিউরিটি গার্ডদের পর্যবেক্ষণের একপর্যায়ে আবদুর রউফের বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড়ের দাগ দেখতে পান ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এর সূত্র ধরে রউফকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে স্বীকার করেন, তিনি এবং অন্য স্থানে ডিউটিরত ইনামুল ওই হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্যে ইনামুলকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যায় ব্যবহৃত গামছা, কাঠের টুকরো, নিহতের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেট ও লুট হওয়া টাকা জব্দ করা হয়।

ডিবির তদন্তে বেরিয়ে আসে- ঘটনার দিন সকালে ডিউটি করেন সিকিউরিটি গার্ড ছোট জাহাঙ্গীর, দুপুর থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ডিউটি করেন সিকিউরিটি গার্ড ইমরান। রাত সাড়ে ১০টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল আবদুর রউফ ও জয় নন্দীর। রউফ ওই বছরের ২৬ অক্টোবর আর ইনামুল ২৬ নভেম্বর গার্ডের চাকরি নেন। রউফের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে। ইনামুলের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। বনানীর ৮২ নম্বর বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিতে এসে রউফ আর ইনামুলের ঘনিষ্ঠতা হয়। সেখানে তারা বিত্তবানদের জীবনযাত্রা দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। আলাপচারিতায় কীভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় ভাবতে থাকেন। হত্যাকান্ডের কয়েক দিন আগে রউফ প্রস্তাব দেন- ‘চীনা নাগরিক গাও অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকাপয়সা নিয়ে আসা-যাওয়া করেন এবং ফ্ল্যাটে একা থাকেন। তাকে শেষ করে দিয়ে যা নিতে পারব তা দিয়ে জীবনে কিছু করা যাবে।’ এরপর তারা সুযোগ খুঁজতে থাকেন। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর তারা মি. গাওকে হত্যার চেষ্টা করলে ব্যর্থ হন। ১০ ডিসেম্বর আবারও হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী ইনামুল তার নিজের ব্যবহৃত গামছা সঙ্গে নিয়ে যান। মাগরিবের আজানের পরপরই তারা গাওয়ের ফ্ল্যাটের সামনে যান এবং রউফ কলিং বেলে চাপ দেন। শব্দ শুনে গাও দরজা খুলে দিলে মুহূর্তেই তারা ভিতরে ঢুকে পড়েন। ইনামুল গাওয়ের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরেন এবং রউফ কোমরের দিকে জাপটে ধরেন। অল্প সময়েই গাওয়ের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রউফের বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড় দেন গাও। তারা ২-৩ মিনিটেই গাওয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। গাওয়ের ব্যাগে থাকা ১ হাজার টাকার ৩টি বান্ডিল নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যান। এর মধ্যে রউফ নেন ১ লাখ ৭৬ হাজার আর ইনামুলকে দেন ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। তারা বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে তাদের গ্রামের বাড়ি টাকাগুলো পাঠিয়ে দেন। রাত ১১টার দিকে বাড়ির পেছনে বালুমাটিতে কাঠের টুকরো দিয়ে একটি ছোট নালা গর্ত করেন। পরে গাওয়ের ফ্ল্যাট থেকে লাশ নিয়ে এসে চাপা দেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় গাওয়ের কাজের বুয়া ফরিদা বসকে খুঁজে না পেয়ে বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডদের বিষয়টি জানান। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে গাওয়ের গাড়ির ড্রাইভার সুলতান মাটিচাপা অবস্থায় পায়ের গোড়ালি দেখে চিৎকার দেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর