শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঢাকার রাস্তায় ব্রিটিশ প্রভাব

মোস্তফা মতিহার

ঢাকার রাস্তায় ব্রিটিশ প্রভাব

ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটেছে ৭৩ বছর আগে। ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে ১৯০ বছরের ইতিহাস শুধু ইংরেজদের শোষণ আর জুলুমের। পতনের সাত দশক পার হলেও এখনো রাজধানীর বুকে রয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের প্রভাব। তিলোত্তমা ঢাকার বুকে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে ব্রিটিশ শাসকদের নামের রাস্তাগুলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারের আমল শেষ হলেও কোনো সরকারই ব্রিটিশ শাসকদের নামে করা রাস্তাগুলোর নাম পরিবর্তনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। রাজধানীর বেইলি রোড, মিন্টো রোড, জনসন রোড, ইংলিশ রোড, র‌্যাংকিন স্ট্রিট, ফ্রেঞ্চ রোড, ফুলার রোড, ফোল্ডার স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, হেয়ার রোড, ওয়াইজ ঘাট, নর্থব্রুক হল রোড- এই রাস্তাগুলো এখনো জানান দিচ্ছে ইংরেজ শাসন আর শোষণ না থাকলেও তাদের প্রভাব এখনো রয়ে গেছে রাজধানীর বুকে। ইংরেজ শাসক জেমস ওয়াইজের নামে বুড়িগঙ্গার তীরে ওয়াইজ ঘাটের নামকরণ করা হয়। বাড়ি-ঘর-জমিদারি সব বিক্রি করে তিনি ইংল্যান্ডে চলে গেলেও এখনো তার নামেই রয়ে গেছে ওয়াইজ ঘাট। ১৮৮৪ সালে ঢাকা নগরীর ম্যাজিস্ট্রেট ওয়্যারের নামেই ওয়ারীর নামকরণ করা হয়। সে সময় ওয়ারী গড়ে উঠেছিল খুবই পরিকল্পিতভাবে। ওই সময় সমাজের অভিজাত নাগরিকরাই ওয়ারীতে বসবাস করতেন। আর পুরান ঢাকার স্থায়ী নাগরিকদের কাছে ওয়ারীই পুরান ঢাকার রাজধানী। বেইলি রোডের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। কেউ মনে করেন মহীশুরের টিপু সুলতানের সঙ্গে কর্নেল বেইলিও সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ জন্য তার নামানুসারে বেইলি রোডের নামকরণ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন ওয়াহাবি আন্দোলন দমনকালে স্পেশাল বেঙ্গল পুলিশের ডিআইজি এইচ বেইলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন বলে তার নামানুসারেই বেইলি রোডের নামকরণ হয়েছে। ১৯০৫ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর ছিলেন জেনারেল লর্ড মিন্টো। ১৯১০ সালে প্রেস অ্যাক্ট পাস করে গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরেন তিনি। এ আইনের ফলে সরকারের কোনো রকম স্বাধীন সমালোচনাই করা সম্ভব ছিল না। প্রচ- জনরোষের মুখে ১৯১০ সালের নভেম্বর মাসে মিন্টো পদত্যাগ করে নিজ দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বাসভবনগুলো মিন্টো রোডে অবস্থিত। এ কারণে মিন্টো রোড বর্তমানে মন্ত্রিপাড়া হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশের প্রথম লে. গভর্নর জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলারের নামানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রোডের নামকরণ করা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে শ্রেণিটি বিক্ষোভ করেছিল, ফুলার তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। ফুলার জনহিতৈষী ছিলেন বলে লর্ড মিন্টোর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আর মিন্টোর চাপের মুখেই পদত্যাগ করে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৮৯৩ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ব্রিটিশ শাসক হেয়ার। তার নামানুসারেই প্রধান বিচারপতির বাসভবনের পাশের হেয়ার রোডের নামকরণ করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা পর্যন্ত তিনি এ পদেই অধিষ্ঠিত থাকেন। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, ঢাকার কালেক্টর এবং পূর্ব বাংলা ও আসামের আপিল বিভাগের বিচারক স্যার রবার্ট মিটফোর্ড যখন ঢাকায় আসেন, তখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা। পর্যাপ্ত চিকিৎসা-সুবিধা না থাকায় জনগণের দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন রবার্ট মিটফোর্ড। আর তার নামেই মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং ওই এলাকার নামকরণ করা হয়। ঢাকার একসময়কার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন ইংলিশ নামের জনৈক ব্যক্তি। তার সম্মানার্থে ধোলাইখাল পাড়ের রাস্তাটির নামকরণ হয়েছে ইংলিশ রোড। ঢাকার আরেক বিভাগীয় কমিশনারের নাম ছিল এফ সি ফ্রেঞ্চ। তার সম্মানে ১৯১৮ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির এ রাস্তার নাম রাখা হয় ফ্র্রেঞ্চ রোড। ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে আসেন। আর তার সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে বুড়িগঙ্গার পাশের ওই সময়কার টাউন হলের নামকরণ করা হয় নর্থব্রুক হল। সেটিই বর্তমানে লালকুঠি। আর তার সম্মানে বাংলাবাজারের একটি রাস্তারও নামকরণ করা হয়। এত বছর পরও ঢাকার রাস্তায় ব্রিটিশ আধিপত্য বিরাজ করায় বিভিন্ন জনের কাছে নানা মতামত পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ নাগরিকদের একাংশ চান ঢাকার রাস্তাগুলোকে ব্রিটিশ নামকরণ থেকে মুক্ত করা হোক। আবার আরেকাংশ মনে করেন, অনেক দিনের পুরনো বলে নতুন নামকরণ হলে জনসাধারণ নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে পারে। ‘নামে কিছু আসে যায় না, গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, সে গন্ধ বিতরণ করবেই’- প্রখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক ও নাট্যকার শেকসপিয়রের এই উক্তিকে অনুসরণ করেই হয়তো গত ৭৩ বছরেও ব্রিটিশ শাসকদের নামের রাস্তার নাম পরিবর্তন করেনি এ দেশের কোনো সরকার। নাকি ইংরেজদের খুশি রাখার একটি অভিনব প্রক্রিয়া এমনটিও মনে করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বেশ কয়েকজন বিষয়টি যেহেতু অনেক আগের এবং খুবই স্পর্শকাতর তাই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোনো রকমের সিদ্ধান্ত ছাড়া ব্রিটিশ শাসকদের নামে করা রাস্তাগুলোর নাম পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর