বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির

সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা, মাস্ক ছাড়াই চলছে মানুষ, কর্মক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির

মাস্ক পরে রিকশা চালাচ্ছেন চালক। সচেতনতা নেই যাত্রীদের। গতকাল তোলা ছবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে -জয়ীতা রায়

দেশে আবারও বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। কিন্তু এ ভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে নেই কোনো সচেতনতা। সরকার ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ ঘোষণা করেছে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় চলছে প্রচারণা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাও করা হচ্ছে। তারপরও রাজধানীসহ সারা দেশে মানুষের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের বালাই নেই। অফিস-আদালত, গণপরিবহন, হাট-বাজার, বিপণিবিতান, মার্কেট, লঞ্চ-স্টিমার কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে। তবে ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত মাস্ক ব্যবহারসহ  স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এ সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। এ জন্য সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্যবিদদের। একইসঙ্গে মাস্ক পরাতে বাধ্য করার  জোরালো দাবিও জানান তারা।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অবশ্যই সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সরকার শুধু মুখে বললেই হবে না, বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহারের জন্য কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। মাস্ক পরলে ৯৫ ভাগ করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমি মনে করি, এই মহামারীর সময় রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির চাইতে জনগণকে মাস্ক ব্যবহারে সচেতন করাই উত্তম।’ 

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। মাস্ক পরেন না অধিকাংশ মানুষ। কেউ  কেউ থুতনিতে মাস্ক পরেন। সড়কে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রিকশা। কোথাও মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। আদালতপাড়ায় হাজার হাজার বিচারপ্রার্থী ও তাদের স্বজনদের ভিড়। কারও মুখে নেই মাস্ক। রাজধানীর অলিগলিতেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বালাই  চোখে পড়ে না। দোকানে দোকানে ভিড় করছেন মানুষ।

ফকিরাপুল টিঅ্যান্ডটি কলোনির কাঁচাবাজারে দেখা যায়, মানুষের ভিড়। নিউমার্কেটে, মৌচাক মার্কেটেও প্রচ- ভিড়। কেউ সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। বাজারের  ভিতরে মুদি দোকানগুলোতে দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়। ওই দোকানের বাইরে একটি সাদা কাগজে লেখা ‘স্বাস্থ্যবিধি  মেনে গোল চিহ্ন দেওয়া স্থানে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনুন’। কিন্তু  ক্রেতাদের কেউই তা মানছেন না। তারা গা  ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। দোকানে থাকা কর্মচারীর মুখে কোনো মাস্ক  নেই। বাজারের প্রায় সব দোকানেই একই চিত্র। বাজারের চিত্র দেখে বোঝা মুশকিল যে দেশে করোনাভাইরাস নামে ভয়াবহ কোনো সংক্রমণ ব্যাধি আছে। এখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো দৃশ্যই দেখা যায়নি।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীরা মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করলেও সামাজিক দূরত্ব (ন্যূনতম তিন ফুট দূরত্বে অবস্থান) মানছেন না। প্রবেশপথ  থেকে শুরু করে টার্মিনালের ভিতর এমনকি বিমানে ওঠার সময়ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা যায়, ঢাকা থেকে অন্য  জেলাগুলোর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে স্বাস্থ্য বিধি মানার তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। যাত্রীদের  তোলার সময় কোনো ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্বও। নিম্ন আদালত বিশেষ করে মহানগর জজ কোর্ট এলাকা, সিএমএম আদালত এলাকা, বাহাদুর শাহ পার্ক, সচিবালয়, মতিঝিল শাপলা চত্বর, হাতিরঝিল, উত্তরার আজমপুর, খিলক্ষেত, মাসকট প্লাজা, সংসদ ভবন এলাকায় একই চিত্র।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শীত শুরুর আগেই করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। মৃত্যুর ঘটনাও বেড়েছে। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত একমাত্র সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে তিনটি বিষয় আবশ্যক। বাইরে বের হলে, অফিসের কাজের সময়, ভিড়ের মধ্যে, বাজারে সবসময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক পরলে ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, ২০ সেকেন্ড সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাত না ধুয়ে বাইরে থাকা অবস্থায় নাক, মুখে দেওয়া যাবে না। সাবান না থাকলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামাজিক দূরত্ব মানা। কেনাকাটা করতে গিয়ে বাজারে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। গাদাগাদি করে থাকলে করোনা সংক্রমণ আরও বেশি ছড়াবে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে মাস্ক পরা আবশ্যক। অবহেলা করোনা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। মাস্ক না পরে হাঁচি-কাশি দিলে জীবাণু কণা অর্থাৎ ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়বে। আর্দ্রতা কম থাকায় ড্রপলেট দ্রুত শুকিয়ে অ্যারোসল অর্থাৎ ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হবে। এসব জীবাণু মিশ্রিত ক্ষুদ্রকণা বাতাসে ভাসমান থেকে সংক্রমণ বাড়াবে। অনেক সময় মাস্কেও এত ক্ষুদ্রকণা ঠেকানো সম্ভব হয় না। এতে বাতাসের মাধ্যমে জীবাণুর সংক্রমণ বাড়বে। অন্য সময় দ্রুত মাটিতে ড্রপলেট পড়ে যেত কিন্তু শীতে তা হবে না। শীতে ধুলাও বেড়ে যায়।

সরেজমিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় দেখা যায়, করোনা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই কারও। মাস্ক ছাড়াই চলছে বেচা-কেনা। ক্রেতা-বিক্রেতা অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নেই। বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটোর পাইকারি আড়তে কাজ করছিলেন মাইদুল ইসলাম। তিনি দাঁড়িপাল্লায় টমেটো মাপছেন। সামনে বস্তা ধরে আছেন সুমন নামে এক কর্মচারী। পাশে সবজি কেনার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন রামপুরা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী সাইফুল শেখ। তিনজনের মুখেই মাস্ক নেই। মাস্ক ছাড়া এই ভিড়ের বাজারে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে মাইদুল ইসলাম বলেন, কাজের সময় মুখে মাস্ক পরি না। মাস্ক পরে কাজ করতে অসুবিধা হয়। কাজের চাপ কমলে মাস্ক পরব। এখান থেকে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন কিনা জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভয় তো লাগে। কিন্তু আমাদের কাজই তো পাইকারি বাজারের ভিড়ে। এ জন্য মাস্ক মাঝেমাঝে পরি।’ একই অবস্থা অন্য দোকানদারদেরও।

গতকাল রাজধানীর নিম্ন আদালত পাড়ায় দেখা যায়, মাস্ক ছাড়াই ঘোরাফেরা করছেন অসংখ্য মানুষ। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে চলছে গল্প, শলাপরামর্শ। মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা নেই। ধূমপান, চা পান, হাত মেলানো সবই চলছে। করোনার ভয়াবহতার লেশ মাত্র নেই সেখানে জমায়েত হওয়া মানুষের আচরণে। আইনজীবী মুরাদুল ইসলাম বলেন, ‘এমনিতেই আদালত চত্বরে জনসমাগম বেশি হয়। তার মধ্যে যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয় তাহলে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়। মানুষকে বলেও মাস্ক পরানো যায় না। আমার মাধ্যমে পরিবার করোনায় আক্রান্ত হয় কিনা তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ভিতরে মাইকে মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া হচ্ছে। মাস্ক ছাড়া দেখলে রেলওয়ের কর্মীরা তাদের মাস্ক পরতে বলছেন। কিন্তু স্টেশন থেকে বের হয়েই গেটে সিএনজির জটলায় মাস্ক, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্বের বালাই থাকছে না। স্টেশনে মাস্ক পরে থাকা ব্যক্তিও ভিড়ে মাস্ক খুলে সিএনজিতে উঠছেন। সিএনজি চালকরা থুতনিতে মাস্ক রেখে যাত্রীর জন্য হাঁকডাক করছেন। বনলতা এক্সপ্রেসে রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছেন রাইসুল হোসেন। তিনি বলেন, স্টেশনে, ট্রেনের ভিতরে রেলওয়ের কর্মীরা বারবার মাস্ক পরতে বলছেন। কিন্তু তারা সরে গেলেই মাস্ক খুলে ফেলছে লোকজন। নিজে ঝুঁকিতে থাকছেন সঙ্গে পাশের যাত্রীকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। করোনা সংক্রামক রোগী হওয়ায় এক ব্যক্তি থেকে তার পরিবার, আশপাশের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। প্রতিদিনে করোনার প্রাণহানি দেখেও মানুষ সচেতন হচ্ছে না।

মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে কারওয়ান বাজারে গতকাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। এ সময় পথচারী, ফুটপাথ ও কারওয়ান বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা, রিকশা ও গণপরিবহনের চালক ও যাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে সচেতন করা হয়। ডিএনসিসির পক্ষ থেকে অসচ্ছল জনসাধারণের মাঝে প্রায় ৬০টি মাস্ক বিতরণ করা হয়। এ সময় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ডবিধি এবং সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ প্রয়োগ করে সাতটি মামলায় ১ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর