বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বস্তিতে কেন বারবার আগুন

এবার গভীর রাতে মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুনএবার গভীর রাতে মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুন

আলী আজম

বস্তিতে কেন বারবার আগুন

রাজধানী মিরপুরের কালশীর বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে গত রাতে অগ্নিকান্ডে কয়েক শ দোকানঘর পুড়ে যায় -রোহেত রাজীব

বস্তিতে বারবার আগুন লাগছে। পুড়ছে শত শত ঘর। গৃহহীন হয়ে পড়ছেন খেটে খাওয়া মানুষ। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল নিমিষেই ছাই হচ্ছে। সহায়-সম্বল হারা এসব মানুষের আর্তনাদ ছাড়া কিছুই করার থাকে না। একেকটি বস্তিতে একাধিকবার আগুনের ঘটনা ঘটছে।

রাত গভীর হলে বস্তিতে আগুন লাগছে। সকালের আলো ফুটতেই সর্বনাশা আগুন এসব অসহায় মানুষের সারা জীবনের অর্জন কেড়ে নেয়। এরপর অসহায় খেটে খাওয়া এসব মানুষের মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে নেয়। তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু এসব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কখনো আলোর মুখ দেখে না। আগুনের নেপথ্য অজানাই থেকে যায়। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছে, বস্তিতে অগ্নিকা-ের অধিকাংশ ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা। বস্তির দখল নিয়ে প্রভাবশালীদের দ্বন্দ্বের জেরে আগুনের ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।

 

গত দুই দিনের ব্যবধানে রাজধানীতে তিনটি বস্তিতে আগুন লেগেছে। পুড়ে গেছে অসংখ্য বস্তির ঘর। এর মধ্যে দুটিই ঘটেছে রাতের আঁধারে। আরেকটি ঘটনা ঘটে বিকালে। এসব ঘটনায় একজন দগ্ধ হওয়া ছাড়া তেমন কেউ হতাহত না হলেও পুড়ে গেছে কয়েকশ ঘর ও দোকান। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে নিম্ন আয়ের হাজারো মানুষ। অল্প আয়ের এসব মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নেওয়া হয় না স্থায়ী কোনো প্রতিকার ব্যবস্থা।

কীভাবে ঘটল এসব আগুনের ঘটনা তার সদুত্তর দিতে পারছেন না বস্তিবাসী, ফায়ার সার্ভিস থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কেউ। অনুমানের ওপরে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু ঘটনাগুলো কি শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি আগুন থেরাপির নামে নেপথ্যে রয়েছে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি এবং উচ্ছেদের অপকৌশল তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দু-একটি ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা হলেও সব ঘটনা দুর্ঘটনা নয়। সরলীকরণ করে না দেখে আরেকটু তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে আসল চিত্র। নগর বিশেজ্ঞরা বলছেন, বস্তিতে নানা ধরনের স্বার্থ নিহিত থাকায় সিটি করপোরেশন, থানা পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করে আগুনের সঠিক কারণ বের করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন লাগার উর্বর জায়গা বস্তি। তদন্তে শর্টসার্কিট, অবৈধ গ্যাস লাইনের ঘটনা বেশি পাওয়া যায়। এর বাইরে কোনো ঘটনা থাকলে সেটি দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে খেটে খাওয়া এসব মানুষ আগুনের পর সাময়িকভাবে বিভিন্ন অভিযোগ তুললেও লিখিতভাবে কোনো অভিযোগ করার নজির খুব কম। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৭৪টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৭ কোটি ৩৩ লাখ ১১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে চলতি বছরে কতগুলো বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে তা জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। সর্বশেষ গত সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুর জহুরী মহল্লার বিহারিপট্টি ও মিরপুরের কালশী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। গত সপ্তাহে বুধবার রাত ২টার দিকে বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় রাত সাড়ে ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায়ও অর্ধশত ঘর পুড়লেও কেউ হতাহত হয়নি। তবে, নিশ্চিত হওয়া যায়নি আগুনের কারণ। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বরে মধ্যরাতে এই বস্তিতে একইভাবে আগুনের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা গেছে।

বাউনিয়া বাঁধ বস্তির এক বাসিন্দা জানান, দু-এক বছর পরপরই এই বস্তিতে আগুন লাগে। কিন্তু এসব ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ কখনোই জানা যায় না। বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ আছে বলে জানি। তারা বিভিন্ন সময় বস্তির ঘর ভাড়া, পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ বিল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। বস্তিতে তাদের লোকজন মহড়া দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতারা বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব হাসান বলেন, এই বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই বস্তির একক নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিকাল সোয়া ৪টার দিকে জহুরী মহল্লার বিহারিপট্টিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০ ইউনিট পৌনে ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে মহল্লার ৪০টি টিনশেড ঘর পুড়ে গেলেও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে আগুন লাগার সূত্রপাত সম্পর্কে মহল্লাবাসী ও ফায়ার সার্ভিস সুস্পষ্টভাবে কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি। এর আগে সোমবার রাত পৌনে ১২টার দিকে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট সোয়া এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ৬৫টি ঘর ও দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও জানা যায়নি আগুনের কারণ। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বস্তিগুলো সরকার বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় ভূমি মালিক জমি খালি করার জন্য বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাই সিটি করপোরেশন, থানা-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করে অগ্নিকা-ের কারণ বের করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে বস্তিতে আগুন নতুন কিছু নয়। সামাজিকভাবে কর্মপরিচয় নিচু হওয়ায় তাদের কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। ফলে, আগুন লাগার পরে শর্টসার্কিট, গ্যাস লিকেজ, সিলিন্ডার বিস্ফোরণসহ নানা রকম দুর্ঘটনামূলক কারণ প্রতিষ্ঠা পায়। অথচ এই বস্তি ঘিরেই রয়েছে প্রভাবশালী মহলের নানা রকম স্বার্থ। ফলে প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে স্বার্থান্বেষী মহল জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে এ ঘটনাগুলো ঘটাতে পারে। হয়তো দু-একটি ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা হতে পারে। কিন্তু অল্প সময়ে বারবার আগুনের ঘটনাগুলো একটু তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে নেপথ্যের কারণ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, বস্তির ঘরগুলো বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। যার ফলে বস্তিগুলো আগুন লাগার উর্বর জায়গা বলা হয়। পাশাপাশি বস্তির ঘরগুলোতে নিম্ন মানের তার ও পাইপ দিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনের সংযোগ নেওয়া হয়। ব্যবহার করা হয় গ্যাস সিলিন্ডার। ফলে অনেক সময় বৈদ্যুতিক তারে প্রেসার পড়ে আগুনের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি শীতকালে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে। এ কারণেও ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার পাশাপাশি অন্য কোনো কারণ আছে কিনা সেটি দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ফায়ার সার্ভিস শুধু আগুনের কারণ খুঁজে বের করে তদন্ত রিপোর্ট দেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর